পাতা:বঙ্গভাষা ও সাহিত্য - দীনেশচন্দ্র সেন.pdf/৬৬৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

পরিশিষ্ট (፩ Sጝ একদিন ধোপার মেয়ের ধোওয়া কাপড়ে তাহার পাঁচটি আঙ্গুলের সুগন্ধি দাগ দেখিয়া ভ্রমরের মত মাতোয়ারা হইয়া গিয়াছিলেন, তিনি ভ্রমরের মতই কাঞ্চনপুষ্পটি ছাড়িয়া রুক্মিণীপুষ্পে আকৃষ্ট হইলেন। তারপর কি নিদারুণ নৈরাশ্যের ইতিহাস-স্যে করুণ বারমাসী পাঠ করিতে পাঠকের চিত্ত বিগলিত হইয়া যায়। হতভাগিনী তখনও দুরাশা ছাড়ে নাই-রাজকুমার আমার জন্য কত হীরা মণি লইয়া আসিবেন, দরিদ্র, আমি তাহার প্রতিদানে কি দিব ? আমার দুটি চোখের জলের দাম দিয়া তাহা কিনিয়া লইব । এক একটি মাস। তঁহার মন আশা-নিরাশার দ্বন্দ্বে বিদীর্ণ করিয়া, তাহার হৃদয় দাগিয়া দিয়া চলিয়া গেল, বার মাস অতিবাহিত হইল--তের মাসের শেষের দিনে কাঞ্চন নিজগৃহের প্রদীপটি ফুৎকারে নিবাইয়া অন্ধকারে নিজকে ঢাকা দিলেন। তারপর তামসাগাজির বাড়ীর দৃশ্য,—সেখানকার এত স্নেহ যত্ন পাইয়াও বালিকার হৃদয়ের হারানো স্মৃৰ্ত্তি ফিরিয়া আসিল না। ছিন্নবৃন্ত কুসুমের কাছে মুদু সমীরের মেহকথা, বা অরুণ কিরণের 'উষ্ণত্ব নিস্ফল।। তমাদাগাজির পর্যটন বৃত্তান্তটি অল্প কথায় কৌতুহলপ্রদ ও বিচিত্র, সেই প্রসঙ্গে হঠাৎ বালিকা যখন তাহার শোকাৰ্ত্ত পিতার কথা শুনিল, তখন সে কঁাদিয়া কাটিয়া তমসাগাজির পায়ে ধরিয়া বাড়ী ফিরিয়া আসিল। . বিরহ-বিধুরার করুণ শেষ দৃশ্য মৰ্ম্মান্তিক, নদীব জলে ডুবিয মরিবার জন্য সে গিয়াছে—তাহার তৎকালীন জীবনের চূড়ান্ত সুখ রাজকুমারের শেষ দর্শন সে পাইযাছে -আর তার কোন সাধ নাই। সে রাজকুমার ও রুক্মিণীর মিলন দৃশ্য দেখিয়াছে একদিকে রাজপুত্র অপরদিকে রাজকন্যা, যোগ্যের সঙ্গে যোগ্যার মিলনধোপাব মেয়ে হইয়া রাজরাণী হওয়ার আশা বৃথা, বামন হইয়া চাদ ধরিবার প্রয়াস-বৃথা-গোবরের পোকা হইয়া, পদ্মের আশা-বৃথা । সে মৃত্যুর প্রাক্কালে প্রার্থনা করিতেছে — তাহার মৃত্যুর কথা যেন রাজকুমার না শোনেন। নবসুখোন্মত্ত কুমারের চিত্তে কাঞ্চনের মৃত্যুসংবাদ হয়ত সামান্য একটু বিষাদ আনিতে পারে,-সে। দুঃখটুকুও কাঞ্চন তঁহাকে দিতে অনিচ্ছুক, এজন্য সে বায়ুকে ডাকিয়া বলিতেছে 'চুপ’-নদীর তরঙ্গকে ডাকিয়া বলিতেছে “চুপ’-নদীর ধারে রাজকুমার যে এক সময় কাঞ্চনের জন্য পুষ্পশয্যা করিতেন, তাহার দাগ এখনও আছে, বংশীর সুরে তাহাকে ডাকিয়া আনিতেন-স্বৰ্ণপালঙ্কে অভ্যস্ত কুমার তাহার প্রেমে মাটীর উপর পাতার বিছানা এক সময়েও লোভনীয় মনে করিতেন, সারারাত্রি জাগরণের পর কঁাচা ঘুমে তিনি উঠিয়া যাইতেন, কাঞ্চন প্রভাতকালের ঘুমটুকু ভাঙ্গাইয়া তাহার কাছে বিদায় লইতে বাধ্য হইত, সেই শত অতীতের কথা মনে করিয়া কাঞ্চন একটবার চোখের জল মুছিল, একটিবার দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিল। তারপর শত তরঙ্গোখিত বুদ্ধদের ন্যায় আর একটি বুদ্ধ,দ নদীনীরে মিশিয়া গেল।