পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (অষ্টম খণ্ড).pdf/৩৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : অষ্টম খণ্ড
৩৩৩

নিয়েছিল এই সাধারণ কর্মচারীদের একটি ঘরে, রাতে তার ঘরে এসে আশ্রয় নেয় আরো দুজন ছাত্র। সেই ছাত্র দুজনকে ঘরের ভিতরে ছেড়া কাঁথা লেপ দিয়ে ঢেকে সারারাতটা দরজায় বসে কাটিয়েছে চম্পার মা। রাতে দু- দুবার এসেছিল হানাদাররা।

 জিজ্ঞেস করেছিল চম্পার মাকে কেউ আছে নাকি তোমার ঘরে। চম্পার মা সভয়ে উত্তর দিয়েছিল না কেউ নেই। আমরাই শুধু হানাদাররা ঘরে ঢুকে আর দেখেনি। হয়তো কুমতলব ছিলো দস্যুদের কারো মনে, কিন্তু ওদেরই একজন তাচ্ছিল্যভরে বলেছিল আরো ছোড়ো বিলকুল বুডটি হায়। চম্পার মার পাশের ঘরে বাহির থেকে তালা লাগিয়ে ভিতরে আশ্রয় নিয়ে বেঁচে গিয়েছিল আরো দুজন ছাত্র। কিন্তু বাঁচতে পারেনি ষ্টুয়ার্ড জলিল। চম্পার মায়ের চোখের সামনে তাকে গুলি করে হত্যা করে দস্যুরা।

 এই মৃত্যুর আলিঙ্গন থেকে যারা বাঁচলো তারাই আগামী দিনে বিভীষিকাময় ইতিহাসের সাক্ষী। ভোর থেকে চম্পার মার কানে কাদের যেন করুণ মা-মা আতস্বর ভেসে এলো। চম্পার মা ভাবলো হানাদারদের বুলেটে আহত কারা যেন মৃত্যুর আগে শেষ বারের মতন প্রাণ ভরে মা ডাক ডেকে নিচ্ছে। চম্পার মার হৃদয় সে ডাকে সাড়া দেবার জন্য আকুল হয়ে উঠলো। পায় পায় এগিয়ে গেল চম্পার মা। দুপা এগুতেই দেখলো পাশের তালাবদ্ধ ঘর থেকে মা ডাক ভেসে আসছে।

 চম্পার মা দরজা ঠেলে ফাঁক করে দেখতে চাইলো ওরা জীবিত, অক্ষত, আহত না মৃত। না ওরা দু’জনেই জীবিত ও অক্ষত। ওরা চম্পার মাকে চ্যালাকাঠের মত শক্ত আকাটা জিভে বের করে দেখালো। কিছুই বলতে পারলোনা মুখ ফুটে। চম্পার মা বুঝলো তৃষ্ণায় ওদের জিভ শুকিয়ে গেছে। ফেটে যাচ্ছে বুকের ছাতি কিন্তু পানি খাওয়াবে কি করে চম্পার মা ওদের? তেমন কোন পাত্র যে নেই হাতের কাছে। চম্পার মার মাতৃহৃদয় ব্যথায় মোচড় দেয়ে উঠলো। দৌড়ো- দৌড়ি করে চম্পার মা, তার শেতল আঁচল কলের জলে ভিজিয়ে বাড়িয়ে দিল দরজার ফাঁক দিয়ে।

 সেই ভিজে আঁচল চুষে ডোক গিলে প্রাণ এলো ছেলে দুটোর। তারপর চম্পার মার সাহায্যে দরজা টেনে ফাঁক করে বেরিয়ে ছুটলো যেদিকে দুচোখ গেল। যাবার সময় চম্পার মার উদ্দেশ্যে বলে গেল মা, তুমি আমাদের মা, গর্ভধারিণী মায়ের চেয়ে ও আপন আর মহৎ। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন তোমার কথা মনে থাকবে মা। চম্পার মা, জানেন সেই দামাল ছেলেগুলো আজ কোথায়, কেমন আছে।

 ইকবাল হল থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে বেরুতেই হাতে খালেকের পানের দোকান। খালেক রাতেই পালিয়ে গিয়েছিল। দোকানে ছিল খালেকের কর্মচারী কিশোর ইউসুফ। ইউসুফ রাতে দোকানের ঝাঁপ ঠেলে দিয়ে তালাবদ্ধ করে ভিতরে ছিল হানাদাররা যখন গোলাগুলি ছুড়তে ব্যস্ত তখন এক হানাদারের কণ্ঠ শুনেছিল ইউসুফ, শালালোক সব ভাগ গিয়া। কিন্তু ভোর বেলা হানাদাররা এসে ডেকে তুললো ইউসুফকে। কিছুই বললো না, শুধু দোকানে যা কিছু খাবার ছিল বিস্কুট, কেক, টফি সব দিতে বলে একটার পর একটা।

 প্যাকেটের পর প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেয়। সাবান নেয়। পয়সা দেবার প্রশ্নই উঠে না। তারা খায়, ইউসুফকে বলে মন্নু এটা দাও, মন্নু ওটা দাও মন্নু। হিংস্র নেকড়ের আদরের মত তারা আদর করে ইউসুফকে ডাকতো মন্নু বলে। ইকবাল হল হত্যাযজ্ঞের সারারাতের আরেক সাক্ষী এই ইউসুফ। ভোর হবার সাথে সাথে জিনাত আলীরা ঝাঁপ দিয়ে দিয়ে নামলো গ্যারেজের ছাদ থেকে। ঝাঁপ দিয়ে নামতে গিয়ে ডান পাটা ভেঙ্গে গেল রউফের। ভেঙ্গে ডান পায়ের গোছা থেকে সংযোগটা খুলেই গেল। রউফ আর উঠে দাঁড়াতে পারলো না।

 রউফকে আপাততঃ ফেলে রেখেই শিক্ষকদের কোয়ার্টারের দিকে আশ্রয় নিল। কারণ মৃত্যু চতুর্দিকে হায়েনার মত ওঁৎ পেতে বসে রয়েছে। একজনের জন্য সবাইকে বোকার মত মৃত্যুর নীলস্পর্শে বিলীন হবার