পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (চতুর্দশ খণ্ড).pdf/৭১১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

6.79 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ চতুর্দশ খন্ড ২৫৬ | সম্পাদকীয়ঃ আবেদনের গণহত্যা বন্ধ হবে না যুগান্তর ১ এপ্রিল, ১৯৭১ আবেদনে গণহত্যা বন্ধ হবে না সংসদ প্রস্তাব নিয়েছেন। পূর্ব বাংলার মুক্তিযোদ্ধাদের সংগ্রামে তাঁরা অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন। আর নিন্দা করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের গণহত্যার। সংসদ সদস্যদের দৃঢ় বিশ্বাস সাড়ে সাত কোটি মানুষের ঐতিহাসিক সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত জয়যুক্ত হবে। আবেগকম্পিত কণ্ঠে বক্তৃতা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। সর্বস্মতিক্রমে গৃহীত হয়েছে প্রস্তাব। দুনিয়ার বিভিন্ন রাষ্ট্র এবং জনতার কাছে আবেদন জানিয়েছেন সংসদ সদস্যরা। তাঁরা যেন পূর্ববাংলার গণহত্যা বন্ধের জন্য পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ দেন। প্রস্তাবের বয়ান সুন্দর। ভাষায় রয়েছে সরল প্রাণের আকুল ক্ৰন্দন। ধ্বনিত হয়েছে দিশাহারা এবং উদ্বেলিত সাধারণ মানুষের অন্তরবেদনা। সীমান্তের ঠিক ওপারে ফ্যাসিস্ত দসু্যদের নৃশংস অত্যাচারে হাহাকার করছে মানবতা। এপারে দাঁড়িয়ে দেখছেন গণতন্ত্রী ভারতের লক্ষ লক্ষ নরনারী। যাঁরা নরপশুদের উদ্দাম হত্যালীলা থেকে গণতন্ত্র বাঁচাবার কঠিন সংগ্রামে লিপ্ত তাঁদের কাছে হাতিয়ার পৌছে দিতে পারছেন না তাঁরা। প্রতিদিন গড়ে উঠছে শবের পাহাড়। এ অবস্থায় নৈতিক সমর্থনের এবং গাঢ় সহানুভূতির বাস্তব মূল্য কতটুকু? ওপারের মুক্তিযোদ্ধাদের কাতর মিনতি- অস্ত্র নাই। দানবীয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই-এ শেষ পর্যন্ত আমরা জিতবই। হত্যার ব্যাপকতা এড়াবার জন্য দরকার অস্ত্র এবং সমরসম্ভার। ইসলামাবাদের ডাকাত সর্দাররা নৈতিক উপদেশের ধার ধারেন না। তাঁরা বিশ্বাসঘাতক এবং হীনচক্রী। আপোষ আলোচনার অনিচ্ছায় সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র এনেছেন তাঁরা পূর্ববাংলায়। তারপর অতর্কিতে হেনেছেন প্রচন্ড আঘাত। মুজিবর পাকিস্তানকে টুকরো করে ফেলতে চাননি। চেয়েছিলেন ছ’দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন। জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যে তাঁর দল নিরঙ্কুশ সংখ্যাধিক্য। গণতন্ত্রের মৌলনীতি অনুযায়ী তিনিই গোটা পাকিস্তানের সত্যিকারের নেতা। লোকায়ত্ত সরকার পরিচালনা এবং সংবিধান রচনার পুরা দায়িত্ব তাঁর উপর। ভূইফোঁড় ডিকটেটর ইয়াহিয়া তা স্বীকার করেননি। পশুবলে তিনি বাংলাকে বগলদাবা করতে চেয়েছেন। তাঁর ধৃষ্টতা সীমাহীন। মুজিবর রাষ্ট্রদ্রোহী, আর নরাঘতী এবং বিশ্বাসঘাতক সামরিক নেতা ইয়াহিয়া দেশপ্রেমিক। ইসলামাবাদের হঠকারীর এই প্ৰগলভ উক্তিই পূর্ব বাংলাকে ঠেলে দিয়েছে সার্বভৌম স্বাধীনতার পথে। মুক্তিযোদ্ধারা নেমেছেন রাস্তায় দখলকারী সৈন্যদের বাধা দিচ্ছেন জান-প্রাণ দিয়ে। হাজার হাজার শহীদের রক্তে যাদের হাত কলঙ্কিত শুধু আবেদনে বন্ধ হবে তাদের রাক্ষসী ক্ষুধা- এ কল্পনা অবাস্তব। পাকিস্তান দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একদিকে স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশ, অপর দিকে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার। একের হাতে জনতার সনদ এবং অপরের হাতে আসুরিক দল। একের লক্ষ্য গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা এবং অপরের লক্ষ্য তার ধ্বংস। এ দুয়ের মধ্যে কোন মিলন সেতু নেই। যদি থাকত তবে মুজিবর-আয়ুব আলোচনার সময়ই তা বেরিয়ে পড়ত। বাঙালীর উপর ডাল কুত্তাদের লেলিয়ে দেবার প্রয়োজন ইয়াহিয়ার হত না। নয়াদিল্লী কি মনে করেন, বৃটেন এবং আমেরিকা ইয়াহিয়ার উপর সক্রিয় চাপ দেবে? সেন্টোর শরিক হিসেবে আপৎকালে ইসলামাবাদের শাসককুলের পাশে দাঁড়াতে ওরা কি প্রতিশ্রুত নয়? চীন পড়েছে উভয় সংকটে। এতদিন সে দহরম-মহরম করেছে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্গে। এখন পূর্ববাংলার উত্তাল তরঙ্গে নৌকা ভাসাতে তার সরম লাগছে। দুনিয়ার সর্বত্র গণ-আন্দোলনের উদাম সমর্থনে চীনের বিপ্লবী আত্মা নেচে উঠে। পূর্ব বাংলার বেলায় সে নীরব। সোবিয়েট রাশিয়ার পদক্ষেপ সতর্ক। সে মুখ খুলছে না। মার্কিন, সোভিয়েট এবং চীনা অস্ত্র নিয়ে ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ত বর্বরদল চালাচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যা। সামরিক অস্ত্র ব্যবহৃত হচ্ছে অসামরিক জনতা ধ্বংসে। গণহত্যা প্রতিরোধে এদের সাহায্য পাওয়া দুঃসাধ্য। অথচ তাদের সমর্থন ছাড়া রাষ্ট্রসংঘে এক পাও এগুনো যাবে না।