বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
76

যাতে তাদের বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত যে সমস্ত অবশিষ্ট সৈনিক ছিল তারা নিরাপদে আরো পশ্চাৎঘাঁটি অনন্দপুর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে। এর কিছু পরে দুটোর সময় তাদের গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাগুলি বন্ধ হয়ে যায়। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে নীরবতা নেমে আসে। আমরা কিছুক্ষণ আবার তাদের পুনঃআক্রমণের জন্য অপেক্ষা করতে থাকি, কিন্তু পরে জানতে পাই যে তাদের অবস্থা সত্যি বিপর্যস্ত এবং তাদের মনোবল একেবারেই ভেঙ্গে গেছে। পুনঃআক্রমণের শক্তি আর তাদের নেই। সমস্ত যুদ্ধক্ষেত্রে তাদের অন্ততঃপক্ষে ৩০০ জনের মৃতদেহ পাওয়া যায় এবং ছিলোনিয়া নদীতে কত ভেসে গেছে সেটারও হিসাব আমরা পাই না। পরে জানতে পারি যে পাকিস্তানীরা একটা ব্যাটালিয়নের চেয়েও বেশী সৈন্যদল নিয়ে এ আক্রমণ চালিয়েছিল এবং এ ব্যাটিলিয়নের ৬০ ভাগের মত লোক নিহত বা আহত হয়েছে। এদের অনেকের কবর এখনও ফেনীতে আছে।

 এর পর থেকে শত্রুসেনারা আনন্দপুরে স্থায়ী ঘাঁটি করার জন্য বাঙ্কার খোড়ার কাজ করে দিল। আস্তে আস্তে ওদের সৈন্যসংখ্যাও বেড়ে যেতে লাগল। আমরা খবর পেলাম ওর প্রচুর অস্ত্র এবং নতুন সৈন্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকা থেকে এনে সমাবেশ করছে। সঙ্গে সঙ্গে প্রচুর কামান ও ট্যাঙ্ক তারা নিয়ে এসেছে। ৭ই জুনের বেলুনিয়া যুদ্ধের পর তাদের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ এবং হতাহতের সংখ্যা দেখে পাকিস্তানীরা বুঝতে পেরেছিল যে আমি এই জায়গাতে তাদের সঙ্গে আবার সম্মুখ সমরে যুদ্ধের জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ এবং সেজন্য আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী তাদেরকে আমি ফাঁদে ফেলার জন্য তৈরী ছিলাম। পাকসেনারা আমার পরিকল্পনা অনুযায়ী অগ্রসর হয়ে সে ফাঁদে পা দিয়ে যথেষ্ট ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছিল। সে কারণে ভবিষ্যতে তারা যাই করুক খুব সতর্কতার সাথে কাজ করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। বিলুনিয়ার বিপর্যয় পাকিস্তানী সেনাদের সবাইকে বিচলিত করে তোলে। তারা এই সিদ্ধান্ত নেয়, যে কোন উপায়ে বেলুনিয়াকে পুনর্দখল করতেই হবে। তাই তাদের সৈন্য সমাবেশ চলতে থাকে। জেনারেল আব্দুল হামিদ খান, চীফ অফ স্টাফ স্বয়ং জুলাই মাসে ফেনীতে আসেন বেলুনিয়া যুদ্ধের প্রস্তুতি এবং পরিচালনার জন্য। আমি আমার প্রতিরক্ষার অবস্থান আরও শক্তিশালী করার চেষ্টা করি। মন্দভাগ থেকে ক্যাপ্টেন গাফফারকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেণ্ট-এর 'সি' কোম্পানী নিয়ে এবং আর কিছু মর্টার নিয়ে বেলুনিয়া সেক্টরে গিয়ে প্রতিরক্ষাব্যূহ আরো শক্তিশালী করে তোলার নির্দেশ দেই। যেহেতু আমার কাছে আর কোন সৈন্য ছিল না, তাই আমি এ তিনটা কোম্পানী দিয়ে জাফর ইমামকে শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য তৈরী থাকার নির্দেশ দেই। শত্রুরা আমাদের প্রতিরক্ষা থেকে মাত্র ৮০০ গজ দূরে গতিয়ানালার অপর পারে তাদের প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছিল। উভয়পক্ষে অনবরত গোলাগুলি বিনিময় হত, আর তাছাড়া শত্রুদের গোলন্দাজ বাহিনী আমাদের ঘাঁটির উপর অবিরাম শেলিং চালিয়ে যেত। আমাদের সৈনিকদের বাঙ্কার ছেড়ে বাইরে চলাফেরার উপায় ছিল না। কিন্তু শত্রুর এই গোলাগুলির এবং আর্টিলারী ফায়ারিং-এর মধ্যেও আমাদের বীর বঙ্গশার্দুলরা তাদের মনোবল হারায়নি এবং এতে অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। তারা এ গোলাগুলিকে যুদ্ধক্ষেত্রেও বাজনার মত মনে করত। মাঝে মাঝে আমাদের সৈনিকরা পরিত্যক্ত মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে শত্রুদের অনেক হতাহতও করত এবং অনেক সময় ১০৬ মিলিমিটার ট্যাঙ্কবিধ্বংসী কামানের সাহায্যে তাদের বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়ে আসত। এসব আকস্মিক আক্রমণাত্মক কার্যে শত্রুরা যথেষ্ট ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়ত এবং তাদের যথেষ্ট হতাহত হত। তারপরই তারা শুরু করত গোলান্দাজ বাহিনীর সাহায্যে অবিরাম বৃষ্টির মত গোলাগুলি। এভাবে জুলাই মাসের ১৭ তারিখ পর্যন্ত চলল। পাকিস্তানীদের যুদ্ধের প্রস্তুতি দেখে ঐ এলাকার জনমনে যথেষ্ট ত্রাসের সৃষ্টি হয়। প্রথমবারের আক্রমণে যদিও জনসাধারণের বেশী ক্ষতি হয়নি, সেহেতু সেবার শত্রুসেনারা ছিল আমাদের হাতে পর্যুদস্ত। যুদ্ধের বিভীষিকা তারা প্রত্যক্ষভাবে সেবার দেখেছিল কিন্তু এবারের পাকবাহিনীর প্রস্তুতির খবরের সত্যি তারা চিন্তিত হয়ে পড়েছিল। এ সময় ছিল ভরা বর্ষা। সব জায়গাতে ছিল পানি। পানি ভেঙ্গে ছেলেমেয়ে নিয়ে শত্রুদের অকস্মাৎ আক্রমণের মুখে নিরাপদ জায়গায় সরে যাওয়া অসম্ভব হতে পারে। এজন্য আমরা স্থানীয় লোকদের নির্দেশ দেই যাতে তারা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আগেই দূরে সরে যায় বা সরে যেতে পারে। কেউবা স্বেচ্ছায় আর কেউবা নিরুপায় হয়ে বিপদের ঝুঁকি নিয়ে স্ব স্ব স্থানে রয়ে যায়। আমাদের সৈনিকরা প্রতিরক্ষাব্যূহের উন্নতি চালিয়ে যেতে থাকে। যেসব জায়গা দিয়ে শত্রুদের আমাদের অবস্থানের ভিতরে অগ্রসর হওয়ার সম্ভাবনা ছিল আমরা সেসব জায়গাতে মাইন লাগাতে থাকি। ১৭ই জুলাই রাত ৮টায় আমাদের উপর শত্রুরা অকস্মাৎ আক্রমণ