পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/১১৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
88

গোরঙ্গলা অবস্থানের উপর নতুনভাবে আক্রমণ শুরু করে। সেই সঙ্গে তারা আমাদের আশাবাড়ি অবস্থানেও হামলা চালায়। এই দুই আক্রমণ ও আমাদের মেশিনগানের গুলি ও মর্টারের গোলার সামনে তারা পর্যদুস্ত হয়। পাকসেনাদের অসংখ্য হতাহত হয়। দিনের আলোতে আমাদের সৈন্যরা বাঙ্কার থেকে অগ্রসরমান শত্রুদেরকে হতাহত করে। পাকসেনারা তাদের আক্রমণ ভঙ্গ করে দিতে বাধ্য হয় এবং পিছু হটে যায়। আমাদের সৈন্যরা পলায়নপুর শত্রুদেরকে তাড়া করে। যুদ্ধের সময় আমাদের মর্টারের গোলাতে পাকসেনাদের ‘চাপাইতে’ অবস্থিত একটি এ্যামুনিশন এবং রেশন স্টোর এ বিস্ফোরণ ঘটে, ফলে ২১ জন আহত ও কিছু সংখ্যক নিহত হয়। ঐ দিনই লেঃ হুমায়ুন কবিরের একটি দল পাকসেনাদের লাটুমুড়াতে যে অবস্থান ছিল তার পিছনে আক্রমণ চালায় এবং বেশ কয়েকজন আহত এবং নিহত করে। পাকসেনাদের গোসাইস্থল' বি-ও-পি'র একটি টহলদার ক্যাপ্টেন গাফ্ফারের ১টি দল সন্ধ্যা ৬টায় মন্দভাগ বাজারের শত্রু অবস্থানের উপর এবং নাক্তেরবাজার শত্রু অবস্থানের উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে পাকসেনাদের ১২জন নিহত হয় এবং বেশ কয়েকটি বাঙ্কারও ধ্বংস হয়। পাকিস্তানীরা আমাদের মন্দভাগ অবস্থানের উপর কামানের সাহায্যে পাল্টা আক্রামণ চালায়। এতে আমাদের ১ জন নায়েক এবং ৩ জন সিপাই আহত হয়।

 আমাদের স্পেশাল কমাণ্ডোরা জুলাই মাসে ৯,১০,১১ তারিখে ঢাকা শহরে তাদের কার্যকলাপ আরো তীব্র করে। গেরিলা কমাণ্ডার হাবিবুল আলম এবং কাজীর নেতৃত্বে ১টি ইমপ্রুভাইসড টাইম বোমা ফার্মগেটের নিকট পাঞ্জাবীদের ‘মাহরুফ রেষ্টুরেণ্ট' স্থাপন করা হয়। এই রেষ্টুরেণ্টে পাকসেনারা এবং দালালেরা সব সময় আসত। নির্ধারিত সময় অনুযায়ী বোমাটি বিস্ফোরিত হয় এবং এতে ১৬ জন পাকসেনা কয়েকজন দালালসহ হতাহত হয়। এর মধ্যে ৮ জন মারা যায় এবং ১২ জন আহত হয়। হলিক্রস কলেজ ভবনেও কিছু ক্ষতি হয়।

 ৪ জনের আর একটি গেরিলা দল ডি-আই-টি ভবনের নিকট ২ জন প্রহরারত পাকসেনাকে নিহত করে। এই পার্টি এরপর সিদ্দিকবাজারের নিকট ১টি টহলদার পাকসেনাদলকে এ্যামবুশ করে এবং ২/৩ জন পাকসেনা এতে নিহত হয়। মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাঙ্ক, স্টেট ব্যাঙ্ক, নাজ সিনেমা হল, ওয়াপদা ভবন ইত্যাদি স্থানে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। এ সব ঘটনার ফলে সমস্ত ঢাকায় আতঙ্কের সৃষ্টি হয়। পাকসেনারা ব্যাতিব্যস্ত ও সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে। ঢাকার স্বাভাবিক অবস্থাও সম্পুর্ণ নষ্ট হয়ে যায় এবং এলাকাবাসীদের মনোবল আরো বেড়ে যায়।

 জুন মাসে আমি যখন পাকসেনাবাহিনীর সঙ্গে সব ফ্রণ্টে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাম, সে সময় আমি বুঝতে পারলাম যদিও আমাদের যোদ্ধাদের আঘাতে পাকসেনাদের প্রচুর ক্ষতি হচ্ছিল এবং যতই আমাদের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছিল তবুও আমাদের চেয়ে তাদের শক্তি অনেকাংশে বেশি ছিল। বিশেষ করে যেখানে পাকসেনারা শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে বাঙ্কারে অবস্থান নেয় সেখান থেকে তাদেরকে বিতাড়িত করা আমাদের পক্ষে বিশেষ করে সবসময় সম্ভব হতোনা। আমি সবময়ে সংগঠিত গোলন্দাজ বাহিনীর অভাব অনুভব করতাম। বাংলাদেশে অবস্থিত পাকসেনাদের বেশ কয়েকটি গোলন্দাজ রেজিমেণ্ট ছিল। এসব রেজিমেণ্টে যেসব বাঙালী নিযুক্ত ছিল, ২৫শে মার্চের পর অনেককে পাকিস্তানীরা হত্যা ও বন্দী করে। আবার অনেকে পালিয়ে প্রাণ বাঁচায় এবং পরে সেসব গোলন্দাজ বাহিনীর সৈন্যরা আমাদের সেক্টরে যোগ দেয়। তাদের আমি বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেণ্টের সঙ্গে যুদ্ধে নিয়োগ করি। যুদ্ধে এসব সৈন্যরা যথেষ্ট সাহসেরও পরিচয় দিয়েছে। এসব সৈন্যদের নিয়ে আমি একটা গোলন্দাজ বাহিনী গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে গোলন্দাজ বাহিনীর সব সৈন্যকে কোনাবনে একত্রিত করা হয়। একটি নতুন রেজিমেণ্ট গড়ে তোলার জন্য যথেষ্ট কষ্টের সম্মুখিন হতে হয় এবং সেই কষ্ট নতুন রেজিমেণ্টটিকেও বহন করতে হয়। এদের কোন থাকার জায়গা ছিলনা, খাওয়া এবং রান্নার কোন ব্যবস্থাও ছিলনা। রেজিমেণ্টের জন্য বিভিন্ন রকমের প্রকৌশলী লোকের দরকার হয়, কিন্তু সব রকমের সৈন্য আমাদের ছিলনা। তাছাড়া সবচেয়ে বড় জিনিস কামান এবং অন্যান্য সরঞ্জামাদি, যা একটি গোলন্দাজ বাহিনীর জন্য নিতান্ত প্রয়োজন ছিল। আমি পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মিলিটারী অধিনায়কদের সঙ্গে গোলন্দাজ বাহিনীর প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র এবং অস্ত্রের জন্য অনুরোধ জানাই। অনেক ছোটাছুটির পর তারা কয়েকটি ৩.৭ ইঞ্চি ছোট