পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/২৬২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
237

হাসনাবাদ, চূড়ামনি, গাহেরা, সাগরনাল চা-বাগানগুলো অকেজো করা হল। বিস্ফোরক দ্রব্য বেশী ছিল না। তবুও তাই দিয়ে চা-বাগানের বড় বড় মেশিনের যন্ত্রপাতি অকেজো করা হল।

 জুনের প্রথম সপ্তাহে লাঠিটিলা চা-বাগানের উপর মস্তবড় হামলা চালানো হল। জানতে পারলাম লাঠিটিলাতে শত্রুদের এক প্লাটুন সৈন্য পরিখা খনন করে আছে। এই আক্রমণে আমাকে ভারতীয় গোলন্দাজ এবং মেশিনগানের সাহায্য নিতে হয়েছিল। শত্রুদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। আমাদের কাছে যে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র চিল তা দিয়ে শত্রুদের মোকাবেলা করা সম্ভব ছিল না বলে আমাকে ভারতীয়দের সাহায্য নিতে হয়েছিল। এই আক্রমণ ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে হয়েছিল। খুব ভোরে চারটা থেকে ভরতীয় গোলন্দাজ বাহিনী গোলাগুলি শুরু করল এবং মেশিনগান থেকে গুলি ছুড়তে শুরু করল। আর সঙ্গে সঙ্গে আমাদের সৈন্যরা শত্রুর দিকে অগ্রসর হতে আরম্ভ করল। বেলা প্রায় ১১টার সময় শত্রুরা আমাদের সম্মিলিত আক্রমণের মুখে টিকতে না পেরে পিছু হটে যায়। আমার সৈন্যরা তার উপর হামলা করে অনেক গোলাবারুদ এবং অস্ত্র উদ্ধার হয়েছিল। দুটো পাকিস্তানী সৈনিক আহত অবস্থায় ধরে নিয়ে আসা হয়েছিল। একদিন পর আরেকজন পাঞ্জাবী ল্যান্স নায়েককে পাতনী চা বাগানে পাওয়া গিয়েছিল।

 এই যুদ্ধে নায়েক শফিকউদ্দিন আহমদেকে বীরপ্রতিক উপাধিতে ভূষিত করার জন্য সুপারিশ করা হয়েছিল। নায়েক শফিকই হাতাহাতি যুদ্ধে নিজের জীবন বিপন্ন করে গ্রেনেড ছুড়ে আহত সিপাহীটিকে ধরে আনতে সক্ষম হয়েছিল। জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ‘হিট এণ্ড রান' কৌশল অব্যাহত থাকে। বেশীরভাগ চা- বাগানগুলো অকেজো করে দেয়া হলো। এবং স্থির হলো যে গণবাহিনীর ছেলেদের সিলেটের ভেতরে ঢুকানো হবে। এদেরকে বলা হল, সিলেটের ভেতরে গিয়ে ডাকঘর, পুলিশ স্টেশন, বাণিজ্য কেন্দ্রে ইত্যাদিতে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত করতে হবে। এদিকে ক্যাপ্টেন শরিফুল হক জুলাই মাসের মাঝামাঝি দিলখুশ ও জুবীতে অনেক অপারেশন করল এবং খরব পাওয়া গেল দিলখুশ চা বাগানে পাকিস্তানীরা পরিখা খনন করেছে এবং আমাদের জুবী যাবার রাস্তা বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করছে। ক্যাপ্টেন শরিফুল হককে বলা হল দিলখুশে পাকিস্তানী ঘাঁটি ধ্বংস করতে। এই ঘাঁটি ধ্বংস করার জন্য আমাকে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিতে হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হক একজন আর্টিলারী অফিসার। টার্গেট নির্দেশ করার প্রশিক্ষণ তার ছিল। দিলখুশ আক্রমণের জন্য কি কি কাজ করতে হবে তা সৈন্যদেরকে বুঝিয়ে দেয় হল। দিলখুশ থেকে প্রায় এক মাইল দূরের একটা উঁচু লম্বা গাছ থেকে পুরো দিলখুশ এলাকাটা দেখা যায়। আক্রমণ শুরু হল। ক্যাপ্টন হক গাছে চড়ে অয়ারলেস- এর সাহায্য টার্গেট সঠিকভাবে নির্দেশ করতে আরম্ভ করলেন। আমাদের গোলাগুলি পাকিস্তানীদের উপরে পড়তে লাগল। তারা দৌড়াদৌড়া আরম্ভ করল, বুঝা গেল তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। যুদ্ধ যখন শেষ অবস্থায় এসে পৌঁছল তখন শত্রুদের একটা ৩" মর্টরের গুলি এসে হক যে গাছে ছিল তার নিচে এসে পড়ল এবং হক আহত হয়ে পড়ে গেল। আমাদের পক্ষের গোলাগুলি এর পর থেকে ঠিক লক্ষ্যস্থানে পড়েছিল না-এমনি আমাদের উপরেই পড়তে আরম্ভ করল। আমাদের সৈন্যরা তখন পিছু হটতে বাধ্য হল। হককে উদ্ধার করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হল। যদিও এ আক্রমণ সফল হয়নি, তবুও পাকিস্তানীদের মনোবল অনেক ভেঙ্গে গিয়েছিল এবং বেশকিছু হতাহত হয়েছে বলে খবর পাওয়া গেছে। এই এ্যাকশনের পর পাকিস্তানীরা দিলখুশে আর তাদের ঘাঁটি বানায়নি। এই যুদ্ধের জন্য ক্যাপ্টেন হককে বীর উত্তম উপাধির সুপারিশ করা হয়েছিল। আগস্ট মাসে লুবাছড়া, কাড়াবালা, মোকাটিলা, আমলসিদ, ন' মৌজা আমাদের মুক্ত এলাকা বলে ঘোষিত হল। পাকিস্তানীরা এই মুক্ত এলাকা দখল করার জন্য বার বার আক্রমণ চালিয়েছে কিন্তু সফল হতে পারেনি।

 খবর পাওয়া গেল লাটুতে শত্রুসৈন্য (প্রায় এক কোম্পানী) পরিখা খনন করেছে এবং বড়লেখা পর্যন্ত তারা প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। লাটু এমন একটা জায়গা যেটা দখল করা আমাদের পক্ষে খুবই দরকার ছিল। কারণ লাটু দখল করলে শত্রুদের কুলাউড়া-শ্রীহট্ট রাস্তায় চলাচলে অনেক অসুবিধা হবে। মেজর রবের অধীনে প্রায় ৩০০ মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে লাটু দখলের পরিকল্পনা নিলাম। আমার পরিকল্পনা ছিল লাটু রেলওয়ে স্টেশনে