পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
301

 ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ই-পি-আর এবং আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র নিয়ে বড়খাতায় (রংপুর) জুলাই মাসে অপারেশন চালানো হয়। এখানে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নেয়া হয়েছিল। অবশ্য এই আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়। আমাদের সৈন্যদের ভাল প্রশিক্ষণ ছিল না। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। এই সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আমাদের সৈন্যদের সুশিক্ষত এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে।

 প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন অপারেশনে আমাদের ব্যর্থতা আমাদেরকে অনেক শিক্ষা দিয়েছিল। আমাদের নিজেদের দোষত্রুটি শোধরাতে পেরেছিলাম। যার ফলে বিভিন্ন আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলাম।

 অক্টোবর মাস থেকেই আমাদের বিজয় শুরু হয়। অক্টোবর মাসে বড়খাতা, ভুরুঙ্গামারী অমরখানা দখল করতে সমর্থ হই।

 মেজর নওয়াজেশের নেতৃত্বে তিন কোম্পানীর সৈন্য ভূরুঙ্গামারীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাঁটি আক্রমণ করা হয় (জুলাই-আগষ্ট মাসে)। এর আগে ভুরুঙ্গামারীতে রেইড, এ্যামবুশ ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এই আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি।

 এই তিনটি বৃহৎ আক্রমণের ফলে শত্রুবাহিনী বুঝতে পারে যে মুক্তিযোদ্ধারা যে কোন বড় আক্রমণ করতে পারে। তাই তারা আরও সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র আনতে শুরু করে। এ্যামবুশ রেইড এতে আরো বেড়ে যায়। এইসব আক্রমণের ফলে আমরা বুঝতে পারি সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ সংগ্রহ করতে হবে।

 অক্টোবরের মাঝামাঝি ভূরুঙ্গামারীর উপর আবার আক্রমণ চালানো হয় মেজর নওয়াজেশের নেতৃত্বে। তিন কোম্পানী সৈন্য দিয়ে এই আক্রমণ চালানো হয়েছিল। ১৮ ঘণ্টা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ভূরুঙ্গামারী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এই আক্রমণে ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়। শত্রবাহিনীকে আমরা পিছু ধাওয়া করি। শত্রুবাহিনীর সাথে আবার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে লেফটেন্যোণ্ট সামাদসহ অনেকেই শহীদ হন। লেফটেন্যোণ্ট সামাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। জয়মনিরহাটে মসজিদের সামনে তাকে সমাহিত করা হয়। জয়মনিরহাটকে সামাদনগর নামকরণ করা হয়। সামাদের মৃতদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে মুক্তিযোদ্ধা দু'ভাই মৃত্যুবরণ করেন। এদেরকেও সামাদের সাথে সমাহিত করা হয়।

 ভুরুঙ্গামারীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কোম্পানী-হেডকোয়ার্টার ছিল। ঐ বিল্ডিংয়ের এক কক্ষে ১৫ জন যুবতীকে বন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়। কাছাকাছি এক স্কুলের বিল্ডিংয়ে নারী, পুরুষ এবং ছেলেমেয়ে প্রায় ২০০ জনকে বন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের জোর করে খাটিয়ে নিত। অনেককে ভোগের সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল।

 পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অনেকের মৃতদেহু বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ভূরুঙ্গামারীর আশেপাশের সমস্ত বাড়িঘর সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল। চাষাবাদ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। জনমানবের কোন চিহ্নই পাওয়া যায় নাই। চারিদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। সমস্ত এলাকাকে একটা ভুতুরে বাড়ির মত মনে হচ্ছিল। ভূরুঙ্গামারীতে বাঙ্কারের মধ্যে অনেক যুবতীর লাশ পাওয়া যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙ্কারের মধ্যে এসব মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল।