পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
317

 জগদলহাটের আক্রমণটা কিন্তু আমাদের চূড়ান্ত যুদ্ধের মহড়া ছিল। এ ধরনের মহড়া আমরা প্রায়ই করিতাম। ভীত ও নিরাশ পাকিস্তানীরা বহু হতাহতের দরুন হাঁপাইয়া উঠিল। সুযোগ বুঝিয়া আমরা আরও দুই মাইল অগ্রসর হইলাম এবং চাওই নদী আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়া আসিলাম। তাহাতে অবশ্য আমাদেরও কিছু হতাহত হইল। এ পর্যায়ে ৯ই অক্টোবর স্বাধীন বাংলার কমিশন প্রাপ্ত প্রথম ক্যাডেট দলের সদ্য পাশ করা তরুণ সেঃ লেফটেন্যাণ্ট আব্দল মতিন চৌধুরী ও সেঃ লেফটেন্যাণ্ট মাসুদুর রহমান আমাদের সাব-সেক্টরে যোগদান করিলেন। অফিসারের নিতান্তই অভাব ছিল, তাই নতুন হইলেও এতে আমরা যথেষ্ট উপকৃত হইলাম।

 এরপর পাকিস্তানীদের চলাচল একেবারে সীমাবদ্ধ হইয়া পড়িল, কারণ আমরা অগ্রসর হওয়াতে অমরখানা-পঞ্চগড় রাস্তা আমাদের পেট্রল ও প্রতিরক্ষা হাতিয়ারের আঘাত ক্ষমতার আওতায় আসিয়া গেল। আমরা তাহাদের পক্ষে সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিকর রক্ষাব্যূহ রচনা শুরু করিলাম। গড়ে বিভিন্ন অপারেশনে প্রতিদিন পাকিস্তানীদের পাঁচ/ছয়জন করিয়া হতাহত হইতে লাগিল। ২০/২৫ দিন এমনতর চলিল। পাকিস্তানীরা সৈন্য পরিবর্তন ও পরিপূরণ করিতে লাগিল।

 তারপর আমরা দুশমনদের সুদূরবিস্তৃত ঘাঁটিগুলি এমনভাবে ঘেরাও করিয়া বিভিন্ন হাতিয়ারের সাহায্যে আক্রমণ চালাইতে লাগিলাম যাহাতে তাহারা অগ্রবর্তী ঘাঁটিগুলি ছাড়িয়া পিছে হটিতে শুরু করিল। এই সূত্র ধরিয়া ২১শে নভেম্বর বিকাল ৪ ঘটিকায় আমাদের প্রথম অগ্রভিযান শুরু হয় তেঁতুলিয়া-ঠাকুরগাঁ-সৈয়দপুর পাকা রাস্তাকে অক্ষরেখা ধরিয়া। দুশমন পালাইতেছে আর আমরা পিছনে ধাওয়া করিয়া চলিয়াছি। ২২ তারিখ অমরখানা দখল করিয়া জগদলের দিকে অগ্রসর হইতে লাগিলাম। লাল স্কুলের কিছু আগে দুশমনের আভাস পাওয়া গেল। রাত তখন ১১টা। পিছনে বহু কিছু বাকী ভাবিয়া ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার অগ্রগমন বন্ধ করিয়া আত্মরক্ষামূলক পজিশন নিতে বলিলেন। অগ্রাভিযানের অক্ষে ছিল 'বি' ও 'সি' কোম্পানী। ‘বি’ কোম্পানীর অধিনায়ক ছিলেন সুবেদার আব্দুল খালেক আর 'সি' কোম্পানীতে ছিলেন লেফটেন্যাণ্ট আব্দুল মতিন এবং সুবেদার হাজী মুরাদ আলী। আবার তাহাদের ডাইনে-বামে ছিল যথাক্রমে সুবেদার আহমদ হোসেনের ‘এ’ কোম্পানী ও সুবেদার আবু হাশেমের 'ডি' কোম্পানী। তাহারা সকলে নিজ নিজ কোম্পানীর জিম্মাদারী এলাকা বুঝিয়া নিলেন ক্যাপ্টেনের কাছ হইতে।

 পরদিন সকাল হইতে শুরু হইল আমাদের অগ্রাভিযান। আমরা এখন দলে ভারী। আমাদের চার কোম্পানী ছাড়াও ৫/৭ শত মুক্তিযোদ্ধা আমাদের সাথে যোগ দিয়েছে। গোলাবারুদ সাজসরঞ্জামেরও কমতি নাই। কাজেই দুশমনের উপর দিলাম ভীষণ চাপ। দুশমনদের পা এখন শূন্যে। তাহারা বহুদিনের পুরাতন রক্ষাব্যূহসমূহ ছাড়িয়া দিয়া আর পা মাটিতে লাগাইতে পারিতেছে না। তাহাদের ভাব এখন পালাই পালাই, প্রাণ বাঁচাই। আমাদের ভাব মার-মার। তাহারা ভীতসন্ত্রস্ত সদাচকিত পলায়নপর। আর আমরা মহাপ্রাপ্তির বিজয়ের নেশায় আরও শতগুণে উৎসাহিত ও মাতোয়ারা দিগ্বিজয়ী বীরের বেশে অগ্রসরমান। এ যেন অনেকটা নেকড়ে আর মেষের মোকাবিলা। তবু জগদলের নিকট বেশ কয়েকজন আহত ছাড়াও আমার সাব-সেক্টরের সর্বশ্রেষ্ঠ বীর বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লেঃ নায়েক শকিলউদ্দিন শহীদ হন। আমাদের আগে বাড়ার পালা চলিতে লাগিল। কোথাও তুমুল সংঘর্ষ, কোথাও মামুলি, আবার কোথাও একবারে না।

 ২৭শে নভেম্বর। পঞ্চগড় শহর মুক্ত হইল। আগাইয়া চলিলাম। বোদা পৌঁছিলাম। যুদ্ধের সাধারণ বাধাবিপত্তি কাটাইয়া (কোথাও দুশমন কর্তৃক পুল উড়াইয়া দেওয়া, কোথাও বা মাইন পুঁতিয়া রাখা) অগ্রাভিযান জারি থাকিল। ৩রা ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁ শহর কব্জা হইল। ৪ঠা ডিসেম্বর সমাগত। এক্ষণে মিত্রবাহিনী সাঁজোয়া ও গোলন্দাজ ইউনিটসহ আমাদের সঙ্গে আসিয়া যোগ দিলেন। কেননা পকিস্তান ততক্ষণে যুদ্ধ ঘোষণা করিয়াছে এবং মহান ভারতও তাহার চ্যালেঞ্জ গ্রহন করিয়া প্রত্যক্ষ সমরে নামিয়াছে। বাস। আমাদের পায়াভারী। আরও নির্ভয় ও বেপরোয়া হইয়া উঠিলাম- আগে বাড়িয়া চলিলাম। বিরাম নাই। আগে বাড়িতে বাড়িতে একেবারে বীরগঞ্জ-ভাতগাঁও ব্রীজ। এ অগ্রভিযানে ইতিমধ্যে বোদা, বীরগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানে বহু দুশমন হইয়াছে আহত