পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৩৭৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
352

রাজশাহীর লোকের মুখে মুখে। তিনি নিজে অপারেশন পরিচালনা করেছেন শুনে সকলে আনন্দে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলো।

 ক) এক নম্বর গ্রুপে বিশজন লোক দেওয়া হলো- যার কমাণ্ডার সুবেদার ইসমাইলকে করা হয়। তার কাছে দেওয়া হল তিনটি মাঝারি মর্টার আর ৯০টি বোমা। কাজ দেওয়া হল নওয়াবগঞ্জ শহরে ১৪ই আগস্ট রাত দশটা হতে এগারটা পর্যন্ত গোলাবর্ষণ করা।

 খ) দুই নম্বর গ্রুপে ৩৫ জন মুক্তিযোদ্ধাকে দেওয়া হল। কমাণ্ডার নিযুক্ত হলেন সুবেদার আমিরুজ্জামান। মেজর স্বয়ং এই গ্রুপের সাথে রইলেন-তিন গ্রুপের পরিচালনা করবেন অয়ারলেসের সাহায্যে। কাজ দেওয়া হল হরিপুর পুলের উপর হামলা করা এবং প্রহরারত হানাদার বাহিনীর লোকদেরকে হত্যা অথবা বন্দী করে পুলটিকে উড়িয়ে দেওয়া, যাতে করে নওয়াবগঞ্জ আর রাজশাহীর মধ্যেকার একমাত্র সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।

 গ) তৃতীয় গ্রুপের কমাণ্ডার ছিলেন নায়েক সুবেদার আমানউল্লাহ, যাকে দেওয়া হয়েছিল ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধা। কাজ দেওয়া হয়েছিল বিদিলপুর রেলওয়ে পুলটি উড়িয়ে দেওয়ার।

 ছয়খানা নৌকা যোগাড় করা হয়েছিল আগে থেকে। আমাদের নৌকার কাণ্ডারী ৫৯ বছর বয়স্ক হুরমত আলী। সাদা ধবধবে লম্বা দাড়ি-চুলের অধিকারী এই বৃদ্ধের মাথায় ছিল গোল একখানি টুপি। কপালে দেখা যাচ্ছিল সুস্পষ্ট কাল দাগ, এবাদতের চিহ্ন। ছয়টি নৌকায় সকলে গিয়ে উঠলাম। মনে হচ্ছিল যেন আমরা সাগর পাড়ি দিচ্ছি অথৈ জলের মাঝে। হুরমত আলী রওনা হওয়ার আগে কি যেন বিড় বিড় করে পড়ল, তারপর মোনাজাত করল। সকাল নটার সময় আমরা গন্তব্যস্থানের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। হুরমত আলীর নৌকা সকলের আগে ছিল, তাতে ছিলেন মেজর গিয়াস নিজে। সব মিলে ১৭ মাইল রাস্তা অতিক্রম করতে হবে। নৌকার পাল উঠাতেই নৌকার গতিবেগ চার থেকে পাঁচ মাইলে পৌঁছাল।

 সন্ধ্যা হতে না হতেই টারগেটের দু মাইলের মধ্যে পৌছান গেল। কিন্তু সবচেয়ে বন্ধুর আর ভয়াবহ হয়ে দাঁড়িয়েছে এই দুই মাইল রাস্তা। যেতে হচ্ছে মহানন্দার ছোট্ট উপনদী-শাখানদী ধরে। আগে থেকে জানা ছিল মীরজাফরের বংশধরদের বেশকিছু লোক এ অঞ্চলে এসেছে, যারা আলবদর আর রাজাকারের মুখোশ পরে এতদঞ্চলে অবস্থান করছে। বহু কষ্টে আরও এক মাইল পথ অতিক্রম করতে আরও দেড় ঘণ্টা সময় লেগে গেল। এক মাইল রাস্তা আরও যেতে হবে। রাত তখন সাড়ে সাতটা। সাড়ে দশ ঘণ্টা কেটে গেছে নৌকায়। হঠাৎ হুরমত আলী ইশারা দিল সকলকে থাতমে। আমার কাছে এসে ফিস ফিস করে বলল যে, সে রাস্তাটা যেন হারিয়ে ফেলেছে। সব কটা নৌকায় হঠাৎ ফিসফিস শব্দ বেড়ে উঠল আর নীরব গুঞ্জন ভেসে এল। পাশের একটা গ্রামে কিছু হারিকেনের আলো চোখে পড়ল। মেজর গিয়াস হুরমত আলীকে নিয়ে সেই গ্রামে উঠলেন এবং সেখান থেকে একটা ছেলেকে নিয়ে পুনরায় গন্তব্য স্থানের দিকে দৃষ্টি রেখে রওনা হলেন। ভীত সন্ত্রস্ত গ্রাম থেকে উঠানো ছেলেটি নৌকায় উঠে সেদিন এতগুলি মুক্তিযোদ্ধাকে দেখে কেঁদে ফেলেছিল। ভেবেছিল বুঝিবা তার জীবনের অবসান ঘটাবার জন্য তাকে নেওয়া হচ্ছিল।

 হরিপুরের পুল থেকে ছয়শত গজ পেছনে রাত ৯টায় রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ সড়কের উপর এক নম্বর ও দুই নম্বর গ্রুপকে অবতরণ করতে আদেশ দিলেন মেজর গিয়াস। তিন নম্বর গ্রুপকে পাঠান হল বিদিলপুর রেলওয়ে পুলের উদ্দেশ্যে দুটো নৌকা করে। বন্যায় ডুবন্ত রাস্তার উপর দিয়েই নৌকা দুটি অতিক্রম করে গেল। এক নম্বর গ্রুপকে অবতরণ ক্ষেত্রে ডিফেন্স লাগাতে বলে দুই নম্বর গ্রুপ দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে পুলের দিকে অগ্রসর হল সড়কের ডান ও বাঁয়ের কিনারা ধরে। আকাশে চাঁদ ছিল না তবে তারকারাশির মিটিমিটি আলো বন্যার পানিতে পড়ে পরিবেশকে বেশ আলোকিত করে তুলেছিল। প্রায় একশত গজের মধ্যে পৌঁছাতেই আধো আলো আর ছায়ার মাঝে মনে হল কারা যেন তড়িৎ গতিতে পুলের পাশে পজিশন নিচ্ছে। আর একটু অগ্রসর হতেই