পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৩২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
407

ভারতীয় ৯ নং ডিভিশনের অধিনায়কের আলাপ-আলোচনা করে তিনি শিগগিরই যতটা সম্ভব রকেট লাঞ্চার ও অন্যান্য ভারী অস্ত্রপাতি সরবরাহ করবার চেষ্টা করবেন।

 ‘ফ্রগম্যানদের সম্বন্ধে একটা কথা বলে রাখছি। এই ফ্রগম্যানদের দেশের বাইরে থেকে আমদানী করা হয়নি। তারা দেশেরই সরল নিরীহ যুব সম্প্রদায়। বেশীর ভাগই ছাত্র। জুনের শেষ সপ্তাহে বিভিন্ন যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে ওদের যোগাড় করা হয় এবং নবাব সিরাজুদৌল্লার ঐতিহাসিক মুর্শিদাবাদের পলাশী নগরে ভারতীয় নৌ-বাহিনীর তত্ত্বাবধানে এইসব ছেলেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ভারতীয় নৌবাহিনীর লেও কমাণ্ডার মার্টিস ও লেঃ দাসির সহযোগিতায় প্রশংসনীয়ভাবে মাত্র দু'মাসের ভেতর এ সমস্ত কচি গ্রাম্য ছেলেরা দক্ষ ফ্রগম্যানশীপ ট্রেনিং নিয়ে বেরিয়ে আসে। যে কোন মূল্যায়নে মিঃ মার্টিন ও মিঃ দাসের এই আন্তরিক প্রচেষ্টা প্রশংসার যোগ্য।

 আর একদল লোক পলাশীতে এই ফ্রগম্যানশীপ প্রশিক্ষণের উন্নতির জন্য যথাসাধ্য সাহায্য করেছিল। তারা পাকিস্তান নৌবাহিনীর সাবমেরিনে কাজ করতো। ফ্রান্সে যখন একটি বিশেষ কাজে ওদের পাঠানো হয়, তখন সেখান থেকে মুক্তিসংগ্রামের প্রাক্কালে ওর পালিয়ে লণ্ডনে আসে। সেখান থেকে ভারতীয় হাইকমিশনের সহয়তায় দিল্লী পৌঁছে। সংখ্যায় তারা আটজন। খুলনা জেলার অধিবাসী মিঃ রহমতউল্লাহ ওদের অধিনায়ক হয়ে নিয়ে আসে। সত্যিকারভাবে রহমতউল্লাহ একজন দেশপ্রেমিক। ফ্রগম্যানশীপের কলাকৌশল সম্বন্ধে সে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে গড়ে তুলেছে।

 ৯ই সেপ্টম্বর। পারিকল্পনা মাফিক বাংলার ফ্রগম্যানরা সবাই যখন, তখন নৌকাগুলো কি আর পিছনে পড়ে থাকতে পারে। ত্রিকোনা আক্রমণ করার জন্য লেঃ জিয়ার আটজন ফ্রগম্যানসহ আগেই যাত্রা করার কথা। তাকে দুটো রকেট লাঞ্চার, কিন্তু এলএমজি এবং অভ্যন্তরের মুক্তিবাহনীর জন্য প্রচুর পরিমাণ গোলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র দেয়া হরো। নির্ধারিত তারিখমত লেঃ জিয়া কোলকাতার উত্তর-পশ্চিম দিকে বাসন্তী নামক একটা বন্দরনগরী থেকে রওনা হলো।

 বর্ষার মাতামাতি। আবহাওয়া ভয়ানক বিক্ষুব্ধ। নধীগুলো যেন এক-একটা দৈত্যের মত রাগে ফুলছে। বুকে তার পচণ্ড আক্রোশে ফেটে-পড়া বিদ্রোহী তরংগমালা। ফ্রগম্যানদের গোপন ঘাঁটি থেকে নৌকায় করে শমসেরনগর পৌঁছতে হবে। ফ্রান্স থেকে পালিয়ে আসা মিঃ আসাদুল্লাহর নেতৃত্বে তিনটি নৌকায় ত্রিশজন ফ্রগম্যান ‘লিম্পেট মাইন' নিয়ে ১৫ই সেপ্টেম্বর মংলা এবং চালনা বন্দরের পাকিস্তানী বাণিজ্যিক ও নৌবাহিনীর জাহাজগুলো আক্রমণ করার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। ওদের বিদায় দেবার জন্য ১০ই সেপ্টম্বর লেঃ কমাণ্ডার মার্টিস, মেজর রায় চৌধুরী এবং আমি বাংলাদেশ নৌবাহিনীর একটা লঞ্চে করে শমসেরনগর পৌঁছে একটা বাঁকের কাছে অপেক্ষা করতে লাগলাম। এখানে হয়েই জিয়ার নৌকাগুলো যাওয়ার কথা।

 সকাল বেলা- ভয়ানক ঝড়, উথাল পাতাল ঢেউয়ের বুক চিরে নৌকা চালানো খুবই কষ্টকর। বেলা তিনটা পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করলাম। কিন্তু ওদের আসার কোন হদিস পেলাম না। দেরী হবার অবশ্য অনিবার্য কারণ ছিল, কিন্তু ওদের পৌঁছতে বিলম্ব দেখে আমরা খুবই চিন্তিত ও অধৈর্য হয়ে উঠলাম। বিকাল প্রায় সাড়ে চারটার সময় প্রথম নৌকা এসে বাঁকের কাছে পৌঁছলো। কেউ তাদের শিক্ষিত বা মুক্তিবাহিনীর লোক বলে চিনতে পারলো না। কেননা, ওরা বুদ্ধিমত্তার সাথে সাধারণ মাঝি ও জেলের বেশ ধরে আত্মগোপন করে ছিল। পরনে ছিল লুংগী ও ছেঁড়া শার্ট। বৃষ্টির জলে ওদের জামাকাপড় সব ভিজে গিয়েছিল। কেউ কেউ চা বা অন্যকিছু গরম করার জন্য আগুন জ্বালাতে খুব চেষ্টা করতে লাগলো। যা হোক আমাদের অপেক্ষা করতে দেখে ওরা খুবই উল্লসিত হলো। ইতিমধ্যে দেখা গেল, আরো দুটো নৌকা বিক্ষুব্ধ ঢেউগুলোর সাথে যুদ্ধ করতে করতে আমাদের দিকে দ্রুত এগিয়ে আসছে। নৌকাগুলো সব এক জায়গায় হলে, মুক্তিযোদ্বাদের সবাইকে আমাদের লঞ্চে এনে গরম চায়ে আপ্যায়িত করলাম। ছেলেদের মনোবল খুবই উঁচু বলে মনে হলো।