গিয়ে আমাদের প্রতি সহযোগীতার হাত বন্ধ করে দিবে। বিশেষ করে আমার ৯ নং সেক্টর নদীনালায় ভর্তি। পাকবাহিনী গোপালগঞ্জ, বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনার হাজার হাজার গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিতে লাগলো। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আসলে যে কি ঘটছে-আমি জানতাম। গানবোট ধ্বংস করার উপায়ও আমার জানা ছিল। কিন্তু আমার কাছ থেকে বারবার তাগিদ যাওয়া সত্ত্বেও প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার সেসব নতুন অস্ত্র শস্ত্র যোগাবার জন্য কোন আন্তরীক প্রচেষ্টাই করেনি। গানবোট কাবু করতে সামনে কয়েকটা রকেট লাঞ্চারই যথেষ্ট। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশতঃ আমরা সেগুলোও পাইনি। বস্তুতপক্ষে, গানবাট কাবু করতে যায় এ সম্বন্ধে আমি একটা রিপোর্ট তদানীন্তন অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী মিঃ তাজউদ্দীন আহমদকে দেখিয়েছিলাম। তখন তাঁরা ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাদের আশ্বাস সত্ত্বেও এ রকম একটা গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার অর্ধমীমাংসিতই রয়ে গেল। তাদের এই নির্লিপ্ততায় আমি খুব ব্যথা পেলাম; পাগলের মত ছুটে গেলাম চার্লি সেক্টরের অধিনায়কের কাছে। তিনি তাঁর নিজের প্রচেষ্টায় আমাকে গোটা দুয়েক রকেট লাঞ্চার যুগিয়ে দিলেন। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় ও গুলো খুবই অপর্যাপ্ত। যাহোক, সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে চার্লি সেক্টরের অধিনায়ক ব্রিগেডিয়ার এন, এ সালিক মংলা পোর্টের কাছাকাছি একটা গেরিলা ঘাঁটি স্থাপন করতে ও কিছু পথপ্রদর্শক প্রস্তুত রাখতে বললেন। তার কথামত পঞ্চাশজন মুক্তিযোদ্ধাসহ আফজাল নামক ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্টের একজন হাবিলদারকে সেখানে পাঠিয়ে দিলাম। এ ছাড়াও আগে থেকেই মিঃ খিজিরের অধীনে সেখানে একশ' গেরিলা ছিল। মিঃ খিজির খুলনার একজন মেকানিক। হাবিলদার আফজালের যোগ্যতা ও শক্তির পরিচয় পেয়ে মিঃ খিজির উদ্দীপনা পেল এবং ‘বানীশান্ত’ নামক একটি জায়গায় আর একটি ঘাঁটি স্থাপন করলো। এখান থেকেই মংলা বন্দরে হানাদারদের গতিবিধি, সামরিক, শক্তি, জাহাজগুলোকে রক্ষা করার জন্য ওর কতটা সতর্কতা অবলম্বন করেছে ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের কাছে খবরাখবর এসে পৌঁছতে লাগলো।
এখন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হলো 'ফ্রগম্যান' পাঠানো। আগষ্টের শেষ সপ্তাহে লেঃ জিয়া ছ’খানা নৌকা নিয়ে অস্ত্রশস্ত্র- গোলাবারুদ সংগ্রহের আশায় ভারতে এসে পৌঁছালো। সুন্দরবনের একটা বৃহত্তম গেরিলা ঘাঁটির অধিনায়ক লেঃ জিয়া। তার কাছে যেসব অস্ত্রপাতি ও গোলাবারুদ ছিল, তা খুবই অপ্রতুল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরের খবরাখবর সে সবিস্তারে আমার কাছে খুলে বললো। কথার মাঝখানে বারবার সে গানবোট ধ্বংসকারী অস্ত্রশস্ত্রের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দিতে লাগলো। সে জানালো যে পাক হানাদারদের মনোবল একদম ভেঙ্গে গিয়েছে। এখন একমাত্র গানবোটের সাহায্যেই আক্রমণ অব্যাহত রাখছে। আগস্টের দ্বিতীয় সপ্তাহে ক্যাপ্টেন শাহাজাহানকে বরিশাল জেলায় আক্রমণ পরিচালনা করার জন্য পাঠিয়েছিলাম। তার উপর বিশ্বাস রেখে জিয়া জানালো যে, শাজাহান ভাল কাজই করছে। ক্যাপ্টেন ওমর-এই ছদ্মনামে শাহজাহনকে ডাকতাম। ক্যাপ্টেন শাজাহান পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সিগনাল ব্রাঞ্চের একজন অফিসার। সে দুঃসাহস করে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে রাজস্থানের মরুভূমি পার হয়ে একশো মাইল পথ পায়ে হেঁটে বাংলাদেশে আসে। সে আমার সেক্টরে যোগ দেয়ার আগে সে গেরিলা বাহিনীতে দীর্ঘ ছ'মাস প্রশিক্ষণ নিয়েছে। ভালই হলো। একটা গেরিলা বাহিনী তার অধীনে পাঠিয়ে দিলাম। জিয়ার কাছে থেকে এসব খবর পেয়ে আংশিকভাবে খুশী হলাম। পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তাকে আমাদের সর্বাধিনায়কের সদর দফতরে নিয়ে গেলাম। কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার, ওর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করার জন্য সর্বাধিনায়ক সাহেব কোন ঔৎসুক্যই দেখালেন না। যা হোক, কোনরকম বুঝিয়ে-সুঝিয়ে সর্বাধিনায়ক সাহেবকে জিয়ার সাথে একটিবার দেখা করার জন্য কতকটা বাধ্য করলাম।
ভয়ানকভাবে সমস্যা- পীড়িত সর্বাধিনায়ক সাহেব শেষ পর্যন্ত অনেক নিয়ম-কানুন পালনের পর জিয়াকে ডেকে পাঠালেন। অসংখ্য ধন্যবাদ- কয়েক মিনিটের মধ্যেই এ সাক্ষাৎ পর্ব শেষ হলো। এরপর ব্রিগেডিয়ার এন, এ, সালিকের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য জিয়াকে নিয়ে আমি ব্যারাকপুর গেলাম। এটা সেপ্টম্বরের প্রথম সপ্তাহ। ব্রিগেডিয়ার সাকিল খুব ধৈর্য সহকারে লেঃ জিয়ার কথাবার্তা শুনলেন এবং তাকে আশ্বাস দিলেন যে,