আক্রমণের পর কাঁঠালিয়া থানার রাজাকার এবং শান্তি কমিটির লোকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চয় হয়। শান্তি কমিটির লোকেরা কাঁঠালিয়া ছেড়ে পালিয়ে যায়। ৪০ জন রাজাকার কাঁঠালিয়া ছেড়ে যায়। ৫ জন রাজাকার আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
পটুয়াখালী থেকে পাকসেনারা পায়রা নদী দিয়ে বামনা-বরগুনা না গিয়ে অনেক ঘুর-পথে মির্জাগঞ্জের পাশ দিয়ে খালের মধ্যে দিয়ে লঞ্চে যেত। আগষ্টের প্রথম আমরা তাদের গতিবিধিতে বাধা দেবার জন্য মির্জাগঞ্জের নিকটে খালের দুধারে এ্যামবুশ পাতি। ১টি লঞ্চ করে যখন পাকসেনারা যাচ্ছিল তখন মির্জাগঞ্জের নিকটে আমাদের এ্যামবুশ পড়ে যায়। লঞ্চটি আমাদের হামলায় খুবই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সঠিক হতাহতের সংখ্যা জানা না গেলেও পরে লোকমুখে জানা যায় যে, পাকসেনাদের ১০ জন নিহত হয়েছে।
বিশখালী নদীতে পাকসেনারা গানবোটে করে পাহারা দিত। রাতে তারা পাহারা দিত বলে আমাদের গতিবিধির জন্য অসুবিধার সৃষ্টি হয়। দিনের বেলার তারা থানার থানার নামত এবং এলাকার অবস্থা সম্বন্ধে জিজ্ঞেস করত। নদী খুব বড় থাকায় তারা আমাদের রাইফেলের আওতায় বাইরে থাকতো, গুলিতে কিছু হত না। সেজন্য আগষ্টের শেষে পরিকল্পনা নিই দিনের বেলা যখন গানবোট থানার নিকট যাবে তখন আমরা নিকটে থেকে হামলা চালাব। সেইমত আমরা আগে থেকেই বামনা থানার নিকটে অবস্থান নিয়ে তৈরী থাকি। বিকেল ৫টার সময় যখন গানবোট তীরে আসে তখন আমরা শত্রুর গানবোটের উপর আচমকা গুলি চালাতে থাকি। এই গুলির জন্য তারা প্রস্তুত ছিল না। গানবোটের সারেং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ফলে গানবোটাট নদীর পাড়ে ধাক্কা খেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তারা বামনায় না থেমে কাঁঠালিয়ার দিকে যায়। সেখানেও তারা এই ঘটনার সম্মুখীন হয়। এরপর শত্রুরা বন্দরে বা থানার নামা বন্ধ করে দেয়, কিন্তু দিনেও রাতে নদীর মধ্যে দিয়ে চলাচল করতে থাকি।
আগষ্ট মাসের শেষ সপ্তাহে সমগ্র পটুয়াখালী এলাকায় আমরা আমাদের তৎপরতা বাড়িয়ে তুলি এবং পাকসেনাদের গতিবিধি অনেক কমে যায়। আগষ্টের শেষে মেজর জলিল ৫০ জন ট্রেইণ্ড যুববকে আমার এলাকায় পাঠিয়ে দেন। তারা তাদের সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আসে। তারা ২টা এল-এম-জিও নিয়ে আসে। ইতিমধ্যে আমার অস্ত্রের সংখ্যা ২০০-তে দাঁড়ায় ও গোলাবারুদ অভাব কিছুটা পূরণ হয়। এই সময় আমি পটুয়াখালী জেলার দুই শহরে পটুয়াখালী ও বরগুনাতে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রবেশ করাই এবং তারা শহরে তাদের কার্যকলাপ শুরু করে। বরগুনা শহরের আশপাশের খাল দিয়ে বিশেষভাবে তৈরী সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারপযোগী গানবোট চলাচল করত। আমরা তার উপর হামলা চালাতাম এবং প্রয়োজন হলে বরগুনায় ঢুকে আক্রমণ চালাতাম। পাকসেনাদের আমরা সমানাসামনি আক্রমণ না চালিয়ে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ চালাতাম।
আগষ্টের শেষের দিকে পাকসেনারা আমাদের মহিষপুর ক্যাম্পে আকস্মিকভাবে হামলা চালায়। মহিষপুর ছিল তালতলী বন্দরের নিকটে অবস্থিত। এখান থেকে মুক্তিযোদ্ধারা আমতলী ও কুয়াকাটা থানায় হামলা চালাত। এ মহিষপুর থেকে বঙ্গোপসাগরের দূরত্ব ছিল খুবই কম। মহিষপুরের পিছনে জঙ্গলে ভর্তি ছিল। পাকসেনারা দালালদের কাছ থেকে আমাদের মহিষপুর অবস্থানের খবর পেয়ে পটুয়াখালী থেকে লঞ্চে ও গানবোটে করে মহিষপুরে আসে। পাকসেনারা ১টি দল মহিষপুর থেকে ৬/৭ মাইল দূরে নেমে হেঁটে আমাদের অবস্থানের দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। অন্যান্য সৈন্যরা গানবোটে করে নদী হয়ে মহিষপুরের সামনে এসে আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। সকাল টার সময় পাকসেনারা তিনদিক থেকে আক্রমণ চালায়। 'আমরা এ আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না। নদীর ধার থেকে আক্রমণ হতে পারে এ আশংকা আমাদের ছিল কিন্তু স্থলপথে আক্রমণ হবে এ আমাদের কল্পনাতীত ছিল। তাদের আমাদের আক্রমণে হতবুদ্ধি হয়ে দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে শত্রুদের মোকাবিলা করি। বরিশাল ও পটুয়াখালী এলাকা সম্বন্ধে পাকসেনাদের জ্ঞান ছিল খুবই কম এবং এ জন্যে তারা এখানে খুব ভীতি ছিল। হামলা মোকাবিলার করার সঙ্গে সঙ্গে পাশ্ববর্তী গ্রাম থেকে আমাদের সমর্থনে জনগণ চিৎকার শুরু করে দেয়। এতে শত্রুরা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মহিষপুর এলাকা পালাতে শুরু করে। এ যুদ্ধে ১১ জন পাকসেনা ও ১১ জন রাজাকার নিহত ও অনেক আহত হয়। তারা অস্ত্রশস্ত্র ও প্রচুর গোলাবারুদ ফেলে পালিয়ে যায়।