পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
455

কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিক থেকে লোকজন আসতে লাগলো। মনে হচ্ছিলো তারা যেন মাটি ফুঁড়ে বের হচ্ছে। হট্টগোল শুরু হয়ে গেলো। ছেলে, বুড়ো, পুরুষ, মেয়েলোক সবাই কাড়াকাড়ি করছে যা পাচ্ছে তুলে নেয়ার জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা ও থানার পাশের পুলিশের বাসাগুলো খালি হয়ে গেলা সে দৃশ্য ভোলার নয়।

 রাতের অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে আমি কিছুসংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রেখে প্রধান দলটি নিয়ে গাজীরচরে চলে এলাম। কিছু সংখ্যক মুক্তিযোদ্ধা রেখে আসার উদ্দেশ্য ছিলো যাতে পাকিস্তানীরা আমাদের পিছু নিতে না পারে। যদিও আমরা ওয়াপদা ভবনের বাংকারগুলো এবং বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থান সম্পুর্ণ ধ্বংস করতে পারিনি, তবুও পকিস্তানী সেনাবাহিনী দারুন ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অতি নিকট থেকে সম্পুর্ণভবে ঘেরাও হয়েও শত্রুসৈন্যরা আত্মসমর্পন করেনি। সত্যিই তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছিলো। আমরা জানতাম আমাদের চলে আসার পর ঐ এলাকার জনসাধারণের উপর পাকিস্তানীরা কি ভয়াবহ অত্যাচার চালাবে! কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। পেছনে ব্রহ্মপুত্র নদীর বিরাট বাধা নিয়ে আমাদের পক্ষে দখল করা অবস্থান আঁকড়ে থাকা সম্ভব ছিলো না। এই আক্রমণের উদ্দেশ্যই ছিলো শত্রুকে অকস্মাৎ আঘাত হানা, যত বেশী সম্ভব শত্রুসেনা খতম করা, তাদের মনোবল ভেঙ্গে দেওয়া, অস্ত্র ও গোরাবারুদ দখল করা। আমরা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলাম।

 আমরা চলে আসার দু'দিন পর পাকিস্তানীরা ঐ এলাকার নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। নিরস্ত্র জাতি এমনভাবে অত্যাচার সহ্য করেই বাংলার স্বাধীনতা এনেছে।

 ওয়ারেণ্ট অফিসার সফিউল্লার নেতৃত্বে যোগাযোগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। তারা শুধু সড়ক এবং রেলপথের ব্রীজগুলো ভেঙ্গে দিয়ে ক্ষান্ত হয়নি, জায়গায় জায়গায় রেলওয়ে লাইন এবং রাস্তা কেটে তারা সমান করে দেয়। বেশ কিছুদিনের জন্য এই যোগাযোগ ব্যবস্থা পাকিস্থানীরা ব্যবহার করতে পারেনি।

 ১৩ই অক্টোবর। বিপুলসংখ্যক যুদ্ধবন্ধী এবং প্রচুর অস্ত্র, গোলাবারুদ নিয়ে আমরা রৌমারী ফিরে এলাম। জনগনের আদালতে ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার বিচার হলো। দেশপ্রেমিক হত্যা, রাজাকার বাহিনী সংগঠন এবং লুণ্ঠনের অপরাধে তারা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলো। বহুসংখ্যক বাঙ্গালী রাজাকার মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। ওয়ারেণ্ট অফিসার সফিকউল্লাহ, নায়ের সুবেদার মান্নান, চাঁদ, দুলু, আলো সুলেমান, নজরুল এবং আরো অনেকের বীরত্ব এবং ত্যাগের কথা কোনদিনই ভোলা যাবেনা। এরাই বাংলার সোনার ছেলে।

॥ মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও কামালপুর অভিযান ॥

 পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে একটা জিনিস দেখে বার বার অবাক হয়েছি। দেখেছি প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মত হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার জন্য নির্বাচিত না হতে পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে গেছে। তারপর যুব শিবিরে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মাইকারচর, ডালুও অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় ওরা আমাকে ঘিরে ধরেছে। সবারই এক প্রশ্ন, আর কতদিন অপেক্ষা করবো? একজন সৈনিক হিসেবে আমি বুঝতে পারি কখন মানুষ ভয়াবহ যুদ্ধকে সহজভাবে গ্রহণ করতে স্বতঃস্ফুর্তভাবে যুদ্ধে যোগ দেয়ার দৃষ্টান্ত আর নেই। গণচীন থেকে শুরুকরে ইন্দোচীনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কোনটাই বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধদের মত এ দৃষ্টান্ত রাখতে পারেনি। চীন ভিয়েনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে, ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির সংগে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলার তরুণরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্য ও আত্মত্যাগের পরিচয়