পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৪৮১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
456

দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন মুক্তিযোদ্ধের ইতিহাসে নেই। মুক্তিযোদ্ধারা এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে অন্য কেউ নয়। যদি কোন দল বা গোষ্ঠী এককভাবে মুক্তিযোদ্ধ তথা জনগনের এই বিজয়কে নিজের বলে মনে করে তা হবে অবৈধ, মিথ্যা। পাকিস্তানী উপনিবেশিক শক্তির শোষণ এত তীব্র ছিল যে বাঙ্গালী জাতির জাতীয়তাবোধ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কারন হবার প্রখরতা অর্জন করেছিল। জাতীয় শোষণ থেকে মুক্তি পাবার তীব্র আকাঙ্খা আদেশের জনগন তথা তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার শক্তি যুগিয়েছে। এ কৃতিত্ব জনগণের আর জনগণের যোদ্ধা তরুন সম্প্রদাযের নিজস্ব।

 আগষ্ট মাসে ১১ নং সেক্টরের কার্যভার গ্রহণ করার পর পাকিস্থানীদের ঘাঁটির উপর আমি কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করি। এই আক্রমণগুলো চালাবার ফলে পাকিস্তানী রণনীতি সম্বন্ধে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ধারনা জন্মে এবং সংগে সংগে মুক্তিযোদ্ধাদের দোষ গুণগুলোও প্রকাশ পায়। পাকিস্তানীরা সে সময় মুক্তিযোদ্ধাদের সম্ভাব্য প্রবেশপথগুলো বন্ধ করার জন্য সীমান্তে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তোলে। এই ঘাঁটিগুলোকে সুরক্ষিত করার জন্য তারা ব্যাপকভাবে কাঁটাতারের বেড়া ও মাইন ব্যবহার করে। ঘাঁটিগুলোর ভিতর মজবুত বাংকার তৈরী করা হয়, যা তাদেরকে কামানের গোলা থেকেও বাঁচাতে পারে। ঘাঁটিগুলোতে নিয়মিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ছাড়াও বেশ কিছুসংখ্যক রাজাকার ও আলবদর রাখা হয়। সীমান্তবর্তী এই সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলো ছাড়াও সড়ক ও যোগাযোগ কেন্দ্রগুলোকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থানে পাকিস্তানী ঘাঁটি গড়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা ঘাঁটিগুলো ছিল অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত।

 কামালপুর ছিল উত্তর সীমান্তে পাকিস্তানীদের একটি সুরক্ষিত ঘাঁটি। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি এই ঘাঁটির উপর আমরা দু'বার প্রত্যক্ষ আক্রমণ চালাই। দু'বারই মুক্তিযোদ্ধরা ঘাঁটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তথাপি তারা ঘাঁটিটি দখল করতে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযোদ্ধারা যখনই ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে সে সময়ই তাদের উপর পাকিস্তানীদের ব্যাপক ১২০ মিলিমিটার মর্টারের গোলা বর্ষিত হয়েছে। বকশীগঞ্জের পাকিস্তানী অবস্থান থেকে এই মর্টারের গোলা ছোঁড়া হতো। শত্রুসেনারা মজবুত বাংকারের ভেতর থাকত বলে এই আক্রমণে তাদের কোন ক্ষতি হত না এবং অবস্থা বেগতিক দেখলেই তারা নিজ অবস্থানের উপর নিজ মর্টার দ্বারা গোলাবর্ষণ করাতো। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানীরা এই রণনীতির কথা চিন্তা করে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তা ব্যাপকভাবে কাজে লাগায়। কামালপুর ঘাঁটির উপর দু'টি আক্রমণ চালিয়ে আমি মুক্তিযোদ্ধাদের দোষগুলোকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করি।

 আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্বলতম দিক ছিল- রাজনৈতিক ও সামারিক নেতৃত্বের অভাব। যে রাজনৈতিক নেতৃত্ব মুক্তিযোদ্ধাকে মুক্তিযোদ্ধের প্রয়োজনীয়তা ও তার মূল লক্ষ্য অন্তরঙ্গ সাহচর্যের মাধ্যমে শিক্ষাদেয় তা কোন সময়ই ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কিভাবে গণসংযোগ করতে হয় তা কোন সময়ই ছিলনা। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মুক্তিযোদ্ধাদের আচরণে তারা জনসমর্থন হারিয়েছে। দ্বিতীয়তঃ সামরিক নেতৃত্বের দুর্বলতা। কয়েক সপ্তাহের ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করা হতো নেতা। প্রায় ক্ষেত্রেই সামরিক জ্ঞানের অভাবে সংকট মুহুর্তে সে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হতো। অবশ্য এই অল্প সময়ে সামরিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করা সম্ভবপরও ছিলো না। এই দুটি প্রধান দুর্বলতা ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধারা সে সময়ে সরবরাহ ও অস্ত্রের দিক থেকে প্রত্যক্ষ আক্রমণের ভূমিকা গ্রহণের উপযুক্ত হয়ে ওঠেন। আগষ্ট মাসের শেষের দিকে ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের আমি নির্দেশ দিই শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণ থেকে বিরত থাকো। শত্রুকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে তার শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে নির্ধারিত স্থানে বের করে আনো এবং হত্যা করো।'

 ৭ এবং ১০ই সেপ্টেম্বরের অভিযানগুলো সুরক্ষিত কামালপুর ঘাঁটি থেকে শত্রু সৈন্যদের কৌশলে প্রলুব্ধ করে নির্ধারিত স্থানে বের করে এনে হত্যা করার সুন্দর উদাহরণ। এই অভিযানগুলো ১১ নং সেক্টরের