পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
478

কোয়েটা থেকে জুলাই মাসের প্রথম সপ্তাহে পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেন- যোগ দেওয়ার পর থেকে শত্রুর উপর প্রচণ্ড আঘাত হানার জন্য অস্থির হয়ে পড়েন।

 ময়মনসিংহের কামালপুর বি-ও-পি ছিল শত্রুদের দুর্ভেদ্য ঘাঁটি, কারণ জল ও স্থল উভয় পথেই কামালপুর- ময়মনসিংহ- ঢাকা সড়কের প্রবেশদ্বার ছিল এ কামালপুর। তাই শত্রুরা এখানে বাংকারগুলো অত্যন্ত মজবুত করে তৈরী করে। বাংকারের প্রথম আস্তরে মাটি ও টিনের দেয়াল, তারপর ৬ ইঞ্চি থেকে ১ ফুট ব্যবধানে রেলের লোহার বীম। এই একই প্রকার ব্যবধানে পাকা সিমেণ্টের আস্তর। বাংকারের ওভারহেড কাভারের বেলায়ও একই প্রকার প্রস্তুতি নেওয়া হতো- প্রত্যেকটি বাংকারই প্রায় ঘরের মত উঁচু, অন্যদিকে সমস্ত ডিফেন্স টানেলের মারফত যোগাযোগের ব্যবস্থা ছিল। এদিকে মাইন, বুবিট্র্যাপ ও বাঁশের কঞ্চি সমস্ত ডিফেন্সটিকে দুর্ভেদ্য দুর্গের মত করে রেখেছিল। পরপর দুদিন রেকি করার পরেও সালাউদ্দীন স্বচক্ষে শত্রুশিবির দেখার জন্য লেঃ মান্নানকে সাথে করে তৃতীয়বারের মত রেকি পেট্রোলিং নিয়ে নিজে শত্রুশিবিরের দিকে গেলেন। বি-ও-পি'র কাছে পৌঁছে জমির আলীর উপর লেঃ মান্নান, সুবেদার হাসিম, নায়েক শফি, ও দলের অন্যান্য সবাইকে রেখে শুধু সুবেদার হাইকে সঙ্গে করে শত্রুর বাংকারগুলো রেকি করতে গেলেন। বলাবাহুল্য, পাকিস্তানীরা রাত্রিতে সব সময় সেকেণ্ড ডিফেন্সে চলে যেত। কামালপুর রণাঙ্গনে শত্রুরা সাধারণতঃ দিনের বেলায় অনেক এলাকা জুড়ে ডিফেন্স নিয়ে থাকত, কিন্তু রাত্রিবেলায় দূরের বাংকারগুলো ছেড়ে দিয়ে ছোট অথচ ঘন ডিফেন্সে চলে যেত। খালি বাংকারগুলি দেখে সালাউদ্দীন ও হাই আরও ভিতরে চলে গেলেন। এমতাবস্থায় দুজন শত্রুসেন সম্ভবতঃ পেট্রোলিং করে ফিরে আসার সময় এদের দুজনের মুখোমুখি হয়ে পড়ে। একশত পাঁচ পাউণ্ড ওজন আর ৫’-৫” উচ্চতা বিশিষ্ট ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীন মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল লম্বা খানসেনার উপর, যার হাতে ৩০৩ রাইফেল। অন্ধকারে খানসেনা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে “আমি খালেদ” বলে নিজেকে সঙ্গীর কবল থেকে ছাড়াতে গিয়ে নিজের ভুল বুঝতে পারল সে। আসলে তারা মুক্তিবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। মুহূর্তের মধ্যে খানসেনা সালাউদ্দীনের হালকা দেহ মাটিতে ফেলে দিয়ে গলা টিপতে শুরু করল। সালাউদ্দীন ‘মান্নান' বলে চিৎকার করে উঠলেন। মান্নান ছুটে এসে স্টেন ধরে জিজ্ঞেস করলো “উপরে কে?” সালাউদ্দীন গোংড়ানীর স্বরে বললো “উপরো তো ঐ শালা”। লেঃ মান্নান গাব গাছের নিচে তাড়াতাড়ি পজিশন নিলেন। এদিকে সুবেদার হাইকে 'হ্যাণ্ডস আপ' বলার সাথে সাথে রাইফেলের বাঁট দিয়ে আঘাত করে খানসেনার জি-থ্রি রাইফেল কেড়ে নিলেন। কিন্তু খানসেনা মুহূর্তের মধ্যে পেছনের বাংকারে ঢুকে পড়লো। আর নায়েক শফি, যে এতক্ষণ ইতস্ততঃ করছিল গুলি করবে কি করবে না (কেননা ঘুটঘুটে অন্ধকারে কার গায়ে গুলি লাগে বলা মুশকিল), মুহূর্তের মধ্যে ধাবমান শত্রুর দিকে গুলি ছুড়ল। অবশ্য ওই গুলি হাই ও খানসেনার মাঝখান দিয়ে চলে যায়। এদিকে শত্রুর বাংকার থেকে গুলি ছুড়ল। সম্ভবতঃ অন্ধকারে ঠাহর করতে পারেনি বলে বাঁ পাশের দালানে গিয়ে লাগে। সংগে সংগে হাই বাংকার লক্ষ্য করে স্টেনের এক ম্যাগাজিন গুলি ছুড়ল। গুলি ছুড়ে জি-থ্রি রাইফেলসহ ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের দিকে এগিয়ে এলো। গাবগাছের পাশ দিয়ে যাবার সময় মান্নান আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো- কে? ত্বরিত বেগে ‘আমি হাই” বলে সালাউদ্দীনের উপরে অবস্থানরত খান সেনাকে স্টেনের ব্যালে দিয়ে গুঁতো দিল। উপরের লোকটি সালাউদ্দীনকে ফেলে দৌড়াতে শুরু করল। সুবেদার হাই ওকে লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ল। অতঃপর রাইফেল দুটি নিয়ে ওরা ত্বরিত বেগে শত্রুশিবির ত্যাগ করে।

 নিশ্চিত মৃত্যুর মুখ থেকে বেঁচে এসে সালাউদ্দীনের সাহস গেল আরও বেড়ে। এ রেকী পেট্রোলিং থেকে দুটি জিনিস বিশেষভাবে পরিলক্ষিতহয়। তাহলো, সুবেদার হাই ও ক্যাপ্টেন সালাউদ্দীনের অদম্য সাহস ও অদ্ভুদ প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব। কিন্তু এতে আবার একটি গুরুত্বপূর্ণ গোপনীয়তা প্রকাশ পায় যে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ আসন্ন, ফলে রাতারাতি শত্রুরা তাদের সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে ফেললো, তাতে করে কামালপুরে পাকবাহিনীর ৩১- বেলুচ ব্যাটালিয়নের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়ালো দুই কোম্পানীতে (রাজাকার ছাড়া)। দুদিন পর ৩০-৩১শে জুলাই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল (সিনিয়র টাইগার) রাতের আঁধারে রওনা হলো। প্রথমে সালাউদ্দীনের ডেল্টা কোম্পানী, ফলো আপ কোম্পানী হলো ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্রাভো, যার পিছে হলো ব্যাটালিয়ন ‘আর’ গ্রুপ এবং এই ‘আর’ গ্রুপে ছিলেন