বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড
482

মাসে পাক অফিসাররা কখনও বা হঠাৎ বলে ফেলতো “ইওর বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ইজ ফাইটিং লাইক রিয়াল টাইগার্স”। আক্রমণটি ব্যর্থ হলেও এর চরম সাফল্য এ উক্তির মাঝেই নিহিত আছে। তাই বুঝি পরবর্তীকালে বন্দী শিবির থেকে পালিয়ে মেজর আজিজ শত দুঃখ কষ্টকে অবনত মস্তকে মেনে নিয়ে যুগ সৃষ্টিকারী কামালপুর রণাঙ্গনে যোগ দেন।

॥ বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণ॥

 ‘জেড' ফোর্সের দ্বিতীয় আক্রমণ পরিচালনা করেন লেঃ কর্নেল শাফায়াত জামিল (৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট) ৩১শে জুলাই তারিখে। প্রায় ৩৫০ জন লোক নিয়ে দেওয়ানগঞ্জ-বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের জন্য ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট রওনা হয়। ঐ অঞ্চলের একটি আই-এ পাস ছেলের বলরামপুর গ্রামের নাসের ছিল এই আক্রমণের পথপ্রদর্শক, যার দূরদর্শিতার ফলে ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট ৩টি বড় বড় নদী ক্ষীপ্র গতিতে সকলের অগোচরে ১১টি নৌকাসহ অতিক্রম করতে সক্ষম হয় এবং গানবোটে পাহারারত পাকসৈন্যদের শূন্যদৃষ্টি এড়িয়ে পাশ কেটে ১৫/২০ মাইল পথ নিরাপদে অতিক্রম করে রাত নিটার সময় পূর্ব নির্দিষ্ট এফ- ইউ-পিছতে পৌঁছতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন আনোয়ারের অধীনে আলফা কোম্পানী নৌকাঘাটে (হাইড আউট) পাহারারত থাকে আর ১২ নম্বর প্লাটুন ই-পি-আর'এর নায়েক সুবেদার আলী আকবরের অধীনে কাট অফ পার্টির কাজ করে।

 'ডি' কোম্পানী লেঃ নূরুন্নবীর অধীনে বাহাদুরাবাদ ঘাট আক্রমণের জন্য অগ্রসর হয়। নায়েক সুবেদার বুলু মিয়া ১১ নম্বর প্লাটুন নিয়ে যায় যাত্রীবাহী ট্রেনের দিকে। আর সুবেদার ১০ নম্বর প্লাটুন নিয়ে যায় রেলওয়ে জেটির দিকে। তখন ভোর হয় প্রায়। রেল লাইনের ওপাশে তখন দুশমনরা ‘স্ট্যাণ্ড-টু'র জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। এদিকে একটি যাত্রীবাহী ট্রেন তখন রেললাইনের উপর শানটিং করছিল। গাড়ী শানটিং করে পিছে যাওয়া সাথে সাথে সুবেদার করম আলী প্লাটুনের রকেট লাঞ্চটির নিজে কাঁধে করে এগিয়ে গিয়ে প্রথমে মালগাড়ীতে অবস্থানরত জেনারেটর এবং পর মুহূর্তে অগ্রসরমান শানটিং গাড়ীর ইঞ্জিনকে ফায়ার করে অকেজো করে দেন। আর সাথে সাথে ডানে অবস্থানরত সুবেদার ভুলু মিয়ার প্লাটুন ফায়ার শুরু করে এবং গ্রেনেড পার্টি রেলের প্রত্যেকে কামরায় গ্রেনেড ছুড়তে শুরু করে। প্রায় প্রত্যেক কামরাতেই ৩/৪ জন করে খাকি পোশাক পরিহিত লোক শুয়েছিল। এদিকে এ্যাকশন পার্টি (২টি প্লাটুন) ইউথড্রয়ালের সাথে সাথে ৩" মর্টার গর্জে ওঠে। ফলে স্থায়ীভাবে যে দুটি শ্রেণীর কামরা আর্মি গার্ডের জন্য রাখা হয়েছিল তা ধসে পড়ে। এছাড়া রেলওয়ে স্টেশন, বহু রেলওয়ে বর্গী এবং ঘাটে অবস্থানরত মালগাড়ীর বহনকারী ষ্টীমার এবং জেটির ছাদের উপর দুশমনের মেশিনগানের বাংকার ভীষনভাবে বিধ্বস্ত হয়। স্টেশন এরিয়া থেকে উইথড্র করাকালে দুশমনের একটি গুলি নায়েক সুবেদার ভুলু মিয়ার বাম বাহুতে লেগে পিঠ দিয়ে বের হয়ে যায়। এই আক্রমণকালে নায়েক সুবেদার ছাড়া আমাদের পক্ষে আর কেউ হতাহত হয়নি। পর দিন সুবেদার করম আলী গেলেন পার্শ্ববর্তী ব্রীজ উড়াতে। ব্রীজ উড়ানোর আওয়াজ শুনে দেওয়ানগঞ্জে অবস্থানরত পাকসৈন্যরা বাহাদুরাবাদ ঘাটের দিকে ধাবমান হল-সঙ্গে সঙ্গে আলফা ও ডেল্টা কোম্পানী ক্ষিপ্র গতিতে দেওয়ানগঞ্জ বাজার, সুগার মিল ও রাজাকার হেডকোয়ার্টার পর্যায়ক্রমে আক্রমণ করে সেই এলাকা সম্পূর্ণরূপে তছনছ করে দেয়।

 তিনদিন বিজয়ের বেশে অবস্থান করার পর ৩য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট নিজ ক্যাম্পে ফেরত আসে। এই আক্রমণটিকে একটি পরিপূর্ণ সার্থক আক্রমণ বলা চলে। এই সফলতার প্রধান কারণ হচ্ছে চৌকস গাইড ধীরস্থির ও সিংহ হৃদয়ের অধিকারী কর্নেল শাফায়াত জামিলের সুষ্ঠু পরিকল্পনা ও দক্ষ পরিচালনা এবং ৩য় ইস্ট বেঙ্গলের ই-পি-আর ও বেঙ্গল রেজিমেণ্টের লোক অধিক সংখ্যায় থাকার জন্য ব্যাটল প্রসিডিউর মোতাবেক কার্যক্রম বাস্তবায়িত করতে পেরেছিলেন বলেই। কিন্তু পূর্ব বর্ণিত ১ম ইস্ট বেঙ্গলের কামালপুর আক্রমণকে (৩০/৩১শে জুলাই) পূণাঙ্গ সার্থক আক্রমণ বলা চলে না কারণ এলাকা দখল করে নিজেদের কব্জার মধ্যে রাখার