পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
501

 কোদালকাটির যুদ্ধে পাকিস্তানী ৭০ জন সৈন্য নিহত হওয়ায় এবং আমাদের নিকট পরাজিত হওয়ায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সৈন্যদের মনোবল অত্যন্ত ভেঙ্গে পড়ে। ফলে কোদালকাটি ও রৌমারী এলাকা সর্বসময় মুক্ত থাকে এবং সেখানে বাংলাদেশের পতাকা উড়তে থাকে।

 সিলেটের চা বাগানসমূহ ও অন্যান এলাকায় যুদ্ধঃ অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে আমাদের ব্যাটালিয়নকে সিলেট সীমান্তে যাওয়ার জন্য আদেশ করা হয়। আমরা উক্ত আদেশ পাবার পর কোদালকাটি এবং রৌমারী ত্যাগ করে সিলেট সীমান্তের বিভিন্ন এলাকায় চলে যাই। সিলেটে বিভিন্ন চা বাগানে পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে থাকত। পাকিস্তান সরকারের উপর অর্থনৈতিক চাপ সৃষ্টির জন্য আমাদেরকে সিলেটের চা ফ্যাক্টরীগুলো সাময়িকভাবে নষ্ট করার আদেশ করা হয়। অক্টোবরের তৃতীয় সপ্তাহে আমাদের ‘এ’ এবং সি’ কোম্পানী শত্রুর ঘাঁটির মাঝখান দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করে ধালাই এবং খাজুরী চা ফ্যাক্টরীর উপর ‘রেইড' করে এবং ফ্যাক্টরীগুলোকে সাময়িকভাবে অচল করে দেয়।

 ১৯শে অক্টোবর আমি 'বি' কোম্পানী নিয়ে চম্পারায় চা ফ্যাক্টরীর উপর ‘রেইড' করি এবং সেটা নষ্ট করে দিই। এ রকম রেইডের সাফল্যে পাকিস্তানী সৈন্যদের মনোবল কিছুটা ভেঙ্গে পড়ে এবং বাঙ্গালী জনসাধারনের মনে অনেক আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার হয়। এ সমস্ত রেইডের সময় ডাঃ মজিবর রহমান অত্যন্ত সাহসের সাথে আমাদের আহত সৈন্যিদের চিকিৎসা করেন এবং আমাদের সঙ্গে সঙ্গে থাকেন। এ সময় সেকেণ্ড লেফটেন্যাণ্ট আনিসুর রহমান ও সেকেণ্ড লেফটেন্যাণ্ট ওয়াকার হাসান নতুন কমিশনপ্রাপ্তির পর আমাদের ব্যাটালিয়নে যোগদান করেন।

 ২৮শে অক্টোবর সকালে আমি 'বি' কোম্পানীকে নিয়ে পাত্রখোলা চা ফ্যাক্টরীর পাকিস্তানী ঘাঁটিতে আর্টিলারীর সাহায্য নিয়ে আক্রমণ করি এবং ঘাঁটিটি দখর করতে সক্ষম হই। একই দিন লেফটেন্যাণ্ট কাইয়ুমের নেতৃত্বে ‘সি' কোম্পানী বালাই শত্রুঘাটির উপর রেইড করে এবং শত্রুপক্ষের বহু সৈন্যকে হতাহত করে। সিপাই হামিদুর রহমান এ রেইডে অভূতপূর্ব সাহসের পরিচয় দেন এবং নিজে গুরুতর ভাবে আহত হওয়া সত্ত্বেও তার এল এম জির সাহায্যে একাই প্রায় ২০ জন সৈন্যকে নিহত করে এ যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে শহীদ হন। বাংলাদেশ সরকার তার এ অসীম সাহসিকতার পুরস্কারস্বরুপ সর্বোচ্চ পুরস্কার “বীরশ্রেষ্ঠ” খেতাব দিয়ে তা শহীদী আত্মার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তাঁর নাম ইতহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে বলে আমরা আশা রাখি।

 ধালাই থেকে শত্ররা পাত্রখোলার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ক্যাপ্টেন মাহবুব মাত্র চারজন সৈন্য সাথে নিয়ে ধালাই এবং পাত্রখোলার বড় সড়কের মাঝামাঝি স্থানে এ্যামবুশ করেন। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাঁর ফাঁদে পা দিলে তিনি শত্রুপক্ষের প্রায় ২০ জন সৈন্যকে নিহত করেন এবং দুইজনকে জীবিত অবস্থায় বন্দী করেন। ঐ দিনই ক্যাপ্টেন পাটওয়ারীর নেতৃত্বে 'ডি' কোম্পানী পাত্রখোলা ফ্যাক্টরীর দুই মাইল দক্ষিণে কাট- অফ পার্টি হিসাবে অবস্থান নেয়। শত্রুর দুই কোম্পানী পাত্রখোলার দিকে অগ্রসর হতে থাকলে 'ডি' কোম্পানী তাদেরকে প্রবলভাবে বাধা দেয়। শত্রু তখন 'ডি' কোম্পানীর অবস্থানের উপর আক্রমণ চালায় কিন্তু ‘ডি’ কোম্পানী তাদের আক্রমণকে ব্যর্থ করে দেয়। শত্রুপক্ষের একজন ক্যাপ্টেনসহ প্রায় ৩০ জন নিহত হয়। আমাদের পক্ষে ৬ জন সৈন্য শহীদ হন।

 ১লা নভেম্বর; এই দিন মিত্র বাহিনীর দুই ব্যাটালিয়নসহ আমাদের ব্যাটালিয়ন মিলে ধালাই বি. ও. পি. এবং ফ্যাক্টরী এলাকা যা শত্রুর সুদৃঢ় ঘাঁটি ছিল তার উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। দুইদিন ধরে অনবরত প্রচণ্ড যুদ্ধের পর শত্রুদের ঘাঁটি দখল করে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানী বাহিনীর ৩০তম ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্টের প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য (প্রায় ২০০ সৈন্য) নিহত ও আরও বহু আহত হয়।

 নভেম্বর মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে সিলেটের চারগ্রাম ও আটগ্রাম এলাকার শত্রুঘাঁটির উপরে কড়া রকমের একটি আক্রমণের পরিকল্পনা করি। এজন্য আমরা সব কমাণ্ডিং এবং কোম্পানী কমাণ্ডারগণ এ এলাকা