পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
515

হয়। আমরা মাঝির ছদ্মবেশে রাতে চাঁদপুরের নিকট দিয়ে নদী পাড়ি দিই। এমন সময় আমরা ঝড়ের মুখে পতিত হই। এর ফলে আমাদেরকে চরের মধ্যে বেশ কিছু সময় নৌকা নিয়ে অপেক্ষা করতে হয়েছিল। রাত্র ১১টা থেকে ৩টা পর্যন্ত আমাদের অভিযান চলার কথা ছিল। আমরা ঠিক সময় আমাদের অভিযন আরম্ব করি কিন্তু দুঃখের বিষয় ভাগ্য আমাদের সুপ্রসন্ন ছিল না। সবই আল্লাহর ইচ্ছা। অবশ্য আমাদের অভিযানের সংকেতধ্বনি বাজানো হয়েছিল তখনকার বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে। আমাদের সংকেত ছিল পঙ্কজ মলিকের লেখা একটা গানের কলি- বধূ আসবে পালকি চড়ে ইত্যাদি। আমাদের অভিযান মুরু হওয়ার কথা ছিল ১৪ই আগস্ট দিবাগত রাত্রে কিন্তু ঐ দিনটি মেঘাচ্ছন্ন দুর্যোগপূর্ণ থাকায় আর তাছাড়া আমাদের পৌঁছানোর নিরাপত্তা না থাকায় অভিযান দুইদিন পিছিয়ে দেওয়া হয়েছিল।

 ১৭ই আগস্ট রাত ১১টায় আমি আমার প্রথম অভিযান চালাই। এর আগে আমি দিনের বেলায় চাঁদপুর শহর ও নদীপথ ভালভাবে পরিদর্শক করে আসি, যাকে 'রেকী' বলা হয়। আমি ছেলেদের ছয়টি দলে ভাগ করে প্রত্যেককে একটি করে লিমপেট মাইন পেটে বেথে উল্টাভাবে সাতার দিয়ে টারগেটের দিকে অগ্রসর হতে নির্দেশ দিই। সংগে আমিও পিছনে রওনা দেই দুইটি মাইনসহ। দুজন ছাড়া সবাই তাদের টার্গেটে মাইন লাগাতে সমর্থ হয়। আমার লক্ষ ছিল সবচাইতে বড় একটি গমের জাহাজ। এজন্য আমি দুটি মাইন নিয়ে অন্য দুজন ছেলেসহ প্রথমে গমের জাহাজের নিচে ডুব দিয়ে নিজ হাতে মাইন লাগাই এবং সংগে আমার সঙ্গী দুজনও মাইন লাগায়। এরপর সাতরিয়ে পদ্মার মুখে এসে পড়ি। এমন সময় সৈন্যবাহী জাহাজ গাজী আমাদেরকে সম্মুখে বাধা দেয়। তখন এদিকে জাহাজে লাগানো মাইন ধুম ধুম শব্দে ফুটতে শুরু করেছে। জাহাজের ভিতরে তখন হৈ হুল্লোড় চিৎকার শুরু হয়ে গিয়েছে। দুই ধার থেকে তখন প্রহরা বাহিনী নদীর মধ্যে অজস্র গুলি ছুড়তে আরম্ভ করেছে। আমার দল তখন গুলির মুখে টিকতে না পেরে ছত্রভঙ্গ হয়ে যে যার দিকে সম্ভব আত্নরক্ষার জন্য দ্রুত সরে পড়ে। অন্য দুই দলসহ আমরা ছয়জন তখন পদ্মা নদীরমুখে গাজী জাহাজের সামনে বাধা প্রাপ্ত হই। তখন আমি একটা বার্জ এর গা ধরে কিছু সময় নিজেকে লুকিয়ে রাখি। প্রায় ভোর হয়ে আসছিল। এদিকে জাহাজও আর সরে না, আমরাও আমাদের পথ চলতে পারি না। কিছু সময় অপেক্ষা করার পর আমার দলের শেষে লাগানো একটি মাইন জেটির কাছে বিস্ফোরিত হয় এবং গাজী তাড়াতাড়ি নদীর মুখে থেকে নদীর ভিতরে চলে যায়। তখন আমরা ঐ সুযোগে তাড়াতাড়ি পদ্মার মুখ পার হয়ে এক পাটক্ষেতের পাশে ঢুকে পড়ি। এমন সময় সকাল হয়ে গেছে। আমরা তখন ৬জন মাত্র একত্রে আছি বাকী যে যার মত পেরেছে নিজেকে বাচানোর জন্য ছুটে গেছে। পূর্ব নির্দেশ মোতাবেক যেখানে আমাদেরকে নৌকায় উঠারে কথা ছিল সেই পূর্বনির্ধারিত স্থানে নৌকা না পাওয়ায় আমরা সবাই বিমূঢ় হয়ে পড়ি। আমাদের তখন শূন্য হাত, কোন অস্ত্র নেই। আছে শুধু সাতার কাটার জন্য পায়ে ফিন। এ অবস্থায় আমি দলবসলসহ এক পাশের বাড়িতে গিয়ে উঠি এবং জোরপূর্বক এক নৌকায় উঠে বসি। নৌকার মালিক আমাদের দেখে জোরে চিৎকার দেয়। আমরা নৌকা নিয়ে অল্প কিছুদূর এসেছি মাত্র এমন সময় চারদিক থেকে আমাদেরকে প্রায় ১০০ নৌকা ঘিরে ফেলে। নৌকাগুলো ঐ সময় নদীতে ইলিশ মাছ ধরছিল। মাঝিরা আমাদেরকে ঘেরাও করে আমাদের দিকে আসতে থাকে। নিকটে আসার পর আমাদের অবস্থা বুঝতে পেরে আমাদেরকে ডুবুরী বলে চিৎকার দেয় এবং আমাদের হিন্দুস্তানী বলে চিহ্নিত করে। আমরা নৌকা প্রায় ধরা পড়ার উপক্রম। সামনে পিছনে সবদিকে পথ বন্ধ। সব নৌকার মাঝিরা চেচামেচি শুরু করে দিয়েছে। তখন বেলা উঠেছে, আমাদেরকে স্পষ্ট দেখা যাচ্চে। এমন সময় আমাদের মাথায় উপস্থিত বুদ্ধি খেলে যায়। আমি আমাদের ছেলেদেরকে সবগুলি ফিন উপরের দিকে উচিয়ে ধরতে বলি। যে বলা সেই কাজ। আমি তখন চিৎকার করে বলি, আমাদের পথ ছাড়, নতুবা আমরা তোমাদেরকে গুলি করে মেরে ফেলবো। আমার হাতে টর্চ লাইট থাকায় সেটা তাদের দিকে উচিয়ে ধরি এবং পথ ছাড়তে বলি। ওদিকে অনবরত চাঁদপুর বন্দরে আমাদের লাগানো মাইন ফাটা আরম্ভ হয়েছে। আমি তাদেরকে ভয় দেখিয়ে বলি ঐ যে শব্দ শুনতে পারছ, আর এই যে আমাদের কাছে বোমা দেখছো, এটা তোমাদের উপর ছেড়ে দেব। যেমন বলা, আর যায় কোথায়, সবাই তখন নৌকা নিয়ে যার দিকে পালাতে শুরু করলো। এর