বিষয়বস্তুতে চলুন

পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
538

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: দশম খণ্ড

শিরোনাম সূত্র তারিখ
২৭। মিত্রবাহিনীর তৎপরতা ও অন্যান্য প্রাসঙ্গিক তথ্য ‘বাংলা নামে দেশ’-অভীক সরকার সম্পাদিত কলিকাতা, ১৯৭২, পৃষ্ঠা ৯৮-১৩৯ ১৯৭১

 ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১। মধ্যরাত্রি থেকেই পুরোদমে শুরু হয়ে গেল ভারত পাক যুদ্ধ। এবং সেই সঙ্গে শুরু হয়ে গেল বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়। চতুর্দিক থেকে বাংলাদেশের দখলদার পাকবাহিনীর উরপ আক্রমণ শুরু করল ভারতীয় সেনা, বিমান এবং নৌবাহিনী। আর বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা।

 সব যুদ্ধই কোনও একটা মুহূর্তে শুরু হয়। কিন্তু তা বলে কোনও যুদ্ধই ঠিক আকস্মিক শুরু হয় না। প্রত্যেকটা যুদ্ধের পেছনে থাকে দীর্ঘদিনের প্রস্তুতি। থাকে বিস্তারিত পরিকল্পনা। যুদ্ধের সম্ভাবনা দেখা দিলেই শুরু হয় সেই প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা। দুপক্ষেরই প্রস্তুতি আর পরিকল্পনা। যেমন এ যুদ্ধেরও ছিল। এবারের ভারত পাক যুদ্ধের। এবং তারই মূল অংশ বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়েরও।

 এপ্রিল-মে থেকেই ভারতীয় এবং পাকিস্তানী প্রতিরক্ষা বাহিনী বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের নিজ নিজ পরিকল্পনা রচনার কাজ শুরু করে দিয়েছিল। আর সেই সঙ্গেই শুরু হয়েছিল প্রস্তুতি। সাধারণত লক্ষ্যটা স্থির করে দেন রাষ্ট্রনায়করা। সমরনায়করা সেই অনুসারে তাদের পরিকল্পনা রচনা করেন এবং প্রস্তুতি গড়েন।

 এপ্রিল মাসের শেষদিকেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীর সামনে ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের কয়েকটা দিক তুলে ধরেছিলেন। বলেছিলেনঃ (এক) বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম চালাবে মূলত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। ভারতীয় সেনাবাহিনী ট্রেনিং এবং অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করবে। (দুই) মুক্তি বাহিনীকে ভারত সরকার সাহায্য দিচ্ছে বলে পাক বাহিনী যদি ভারতের উপর হামলা করে তাহলে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সেই আক্রমণের জবাব দিতে হবে। (তিন) বাংলাদেশের সমস্যার যদি কোনও রাজনৈতিক সমাধান না হয় তাহলে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকেও বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত লড়াইয়ের নামতে হতে পারে। (চার) যদি চূড়ান্ত লড়াইয়ে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনীকে নামতে হয়ই তাহলে তার লক্ষ্য হবে রাজধানী ঢাকাসহ গোটা বাংলাদেশকে দখলদার পাক বাহিনীর কবলমুক্ত করা। (পাঁচ) মুক্তি সংগ্রামে যদি প্রত্যক্ষভাবে ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী নামে তাহলে রাজধানীসহ গোটা বাংলাদেশকে খুব দ্রুতগতিতে মুক্ত করতে হবে। (ছয়) বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনীর অংশ নেওয়া মানেই হবে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের যুদ্ধ। সুতরাং লড়াই শুধু পূর্বে হবে না, হবে পশ্চিমেও। এবং (সাত) পাক-ভারত লড়াই হলে উত্তর সীমান্তে চীনের কথাও মনে রাখতে হবে।

 এই নির্দেশের উপর ভিত্তি করেই ভারতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী দুভাবে তাঁদের পরিকল্পনা রচনা করল এবং প্রস্তুতি গড়ে তুলল। (এক) মুক্তি বাহিনীকে ট্রেনিং দেওয়া এবং তাদের অস্ত্র সরবরাহ করা। (দুই) বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায়ের লড়াইয়ের জন্য পরিকল্পনা রচনা করা এবং তার প্রস্তুতি গড়ে তোলা।

 বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত পর্যায়ে পরিকল্পনা রচনা করতে গিয়ে আমাদের প্রতিরক্ষা বাহিনীকে প্রথমেই কতকগুলি অসুবিধার কথা বিবেচনা করতে হয়। প্রথমত, বাংলাদেশের প্রকৃতি। বাংলাদেশে অসংখ্য নদীনালা। কতকগুলি নদী বিশাল। আর, বাংলাদেশের প্রায় সর্বত্র জলাভূমি এবং এইসব জলাভূমিতেও শীতকালেও কিছু কিছু জল জমে থাকে। দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশের নদীনালাগুলি অধিকাংশই উত্তর থেকে দক্ষিণে প্রবাহিত। তাই পশ্চিম থেকে পূর্বে অগ্রসর হওয়া অত্যন্ত কঠিন। অথচ ভারত থেকে বাংলাদেশে কোনও বড় সেনাবাহিনীকে পাঠাতে হলে নানা কারণে পশ্চিম দিক থেকে পাঠানোই সুবিধা। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে রাস্তাঘাট অত্যন্ত কম। সামান্য কয়েকটি মাত্র পাকা রাস্তা আছে। সেগুলিও অসংখ্য নদীনালার ওপর দিয়ে গিয়েছে। চতুর্থত, প্রয়োজনীয় সংখ্যায়