পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দশম খণ্ড).pdf/৫৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দশম খণ্ড
563

 জেনারেল ওসমানী: দু'রকমের ছিল। সেটা হয়েছে প্রথমে 'স্ট্রং পয়েণ্টটি ক্লিয়ার কারার পরে। মনে করুন, শত্রুর খুব শক্তিশালী একটা ঘাঁটি রয়েছে। সেই ঘাটির উপর ভারতীয় বাহিনী ট্যাঙ্ক কামান দিয়ে হামলা করতো। সেই সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ‘ক্রস কাণ্ট্রি' দিয়ে গিয়ে 'আউটফ্লাঙ্ক' করতো। ক্রস কাণ্ট্রি এগিয়ে যাওয়ার বিশেষ দক্ষতা মুক্তিবাহিনীর ছিল। এর দুটো কারণ ছিল- প্রথমতঃ আমরা ন'মাস নিজের অঞ্চলে যুদ্ধ করে আসছি এবং আমাদের বাহিনী তুলনায় হাল্কা ছিল। দ্বিতীয়তঃ আমাদের সংযোগ ছিল স্থানীয় লোকের সাথে, আমাদের প্রতি তাদের ছিলো পুরো সমর্থন। সেজন্য আমরা সঙ্গে সঙ্গে আউটফ্লাঙ্ক করে শত্রুপার্শ্বভাগ ও পেছন থেকে আক্রমণ করতাম যাতে সে আর টিকতে না পারে। তৎপর যখন অগ্রবর্তী অন্যান্য শত্রু পজিশন আক্রমণ করতে হতো বা এগিয়ে যেতে হতো তখন আমাদের বাহিনী অগ্রসর হতো ও আক্রমণ করতো কারণ অঞ্চলের পথঘাটগুলো আমাদের জানা ছিল, শত্রুর পজিশন সম্পর্কে প্রতি মুহুর্তের খবর আমাদের দেশের অভ্যন্তরে অবস্থিত আমাদের সেলগুলোর থাকতো এবং গেরিলাদের সাথে আমাদের সমন্বয় ও সংযোগ ছিল। আবার এখানেও প্রয়োজন হলে ভারতীয় বাহিনী আমাদেরকে আর্টিলারী বা ভারী কামানের দ্বারা সাপোর্ট দিত।

 প্রঃ ক'টি সেক্টর ছিল? হেডকোয়ার্টার কোথায় ছিল?

 জেনারেল ওসমানীঃ বাংলাদেশকে আমি ১১টি সেক্টরে ভাগ করেছিলাম। ১১টি সেক্টর একেকজন অধিনায়কের অধীনে ছিল। এবং প্রত্যেক অধিনায়কের একটি সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল। এবং এই সেক্টর হেডকোয়ার্টারগুলি বাংলাদশের ভেতরেই ছিল। এই সেক্টরগুলোর উপর ভিত্তি করে আমি যুদ্ধটি লড়েছি। কারণ, বাংলাদেশের মত এত বড় একটা থিয়েটার' অর্থাৎ দেশব্যাপী রণক্ষেত্রে যার ১১টি সেক্টরের মধ্যে রয়েছ অসংখ্য নদীনালা ও ব্যাপক দূরত্ব-কেন্দ্রীভূতভাবে দৈনন্দিন যুদ্ধ পরিচালনার জন্যে যুক্ত সামরিক সদর দফতর, উপযুক্ত পরিমাণ অফিসার ও স্টাফ, যোগাযোগ ব্যাবস্থা ও সম্পদ এবং সঙ্গতির প্রয়োজন তা সংগ্রহ করা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আমার ছিল মাত্র ১০ জন অফিসার বিশিষ্ট একটি ক্ষুদ্র সশস্ত বাহিনীর রণ পরিচালনার হেডকোয়ার্টার। এছাড়া, এতবড় একটা বিরাট অঞ্চলব্যাপী সামগ্রিক যুদ্ধে পরিচালনা আমাদের তখনকার পরিস্থিতিতে শুধু অসম্ভব নয়, অবাস্তবও ছিল। তাই আমি আমার চীফ অব স্টাফ ও অন্যান্য কমাণ্ডারদের কাছে আমাদের জাতীয় লক্ষ্য, আমাদের রাজনৈতিক ও সামরিক বিবেচ্য বিষয়ের সঠিক মূল্যায়ন এবং আমাদের ও শত্রুর কাছে কার্যক্রমের কেন কোন পথ উন্মুক্ত রয়েছে ইত্যাদি বিষয়ে সঠিক চিত্র তুলে ধরি। আমাদের সামরিক লক্ষ্য ও সে লক্ষ্য অর্জনের জন্য যুদ্ধ পরিচালনা সম্পর্কিত আমাদের নির্দেশের (অপারেশনাল ইনস্ট্রাকশন ও অপারেশনাল ডাইরেকটিভ) মাধ্যমে সাধারণভাবে আমাদের বাহিনীর করণীয়, প্রত্যেক সেক্টরে তাদের বিশেষ করণীয়, বিভিন্ন সেক্টরের কার্যক্রমের সমন্বয় সাধন এবং সাংগঠনিক ও যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে জানতাম। আমার এইসব নির্দেশের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিটি সেক্টর কমাণ্ডারদের সাথে আমি লিয়াজোঁ অফিসার ও মুক্তিযোদ্ধাদের মাধ্যমে যোগাযোগ রক্ষা করতাম। এছাড়া আমার কমাণ্ডারদের সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রক্ষা এবং যুদ্ধের অবস্থা সমন্ধে সরাসরি অভিজ্ঞতা লাভের জন্য আমি এক সেক্টর থেকে যেতাম অন্য সেক্টরে। সে অবস্থায় আমি যখন যে সেক্টরে থাকতাম, সে সেক্টরের হেডকোয়ার্টারই হতো আমার হেডকোয়ার্টার। এভাবে প্রত্যক্ষভাবে পরিস্থিতির সঠিক মূল্যায়ন করতাম ও সে অনুযায়ী নির্দেশ দিতাম। এছাড়া যুদ্ধকালীণ মন্ত্রিসভাকেও আমি যুদ্ধের অগ্রগতি ও সামরিক পরিস্থিতির সম্বন্ধে অবহিত রাখতাম।

 যখন বাংলাদেশ সরকার আমাকে সর্বাধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ করেন তখন আমি তাদের অনুমোদন লেঃ কর্নেল (বর্তমানে মেজর জেনারেল) এম, এ, রবকে চীফ অব স্টাফ নিয়োগ করি। তিনি আমার পরে সবচেয়ে সিনিয়র ছিলেন। তিনি গণপরিষদেরও সদস্য।