পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (দ্বাদশ খণ্ড).pdf/২৬০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংরাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ দ্বাদশ খণ্ড
২৩8

কোন সরকার- স্বৈরাচারী সরকার, সেই শাসকগোষ্ঠী, যারা সেখানে মুষ্টিমেয়র প্রতিনিধিত্ব করছেন তাহলে এটা কি আশা করা যায় যে, এক হয়ে সে দেশ এইভাবে থাকতে পারে। সেইজন্য আমরা মনে করি যে, পৃথিবীর সমস্ত গণতান্ত্রিক মানুষ যতই তাঁরা এই ঘটনা বুঝবেন ততই বাংলাদেশের মানুষের সংগ্রামকে তাঁরা সমর্থন করবেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষসহ। পশ্চিম পাকিস্তানেও আজ বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ আছে, বিভিন্ন ইউনিট সেখানে আছে এবং তাদের মধ্যে গণতান্ত্রিক মানুষও আছেন। আজ হয়ত তাঁদের দু’চার জনের ক্ষীণ কণ্ঠস্বর বা তাঁদের কথা আমরা শুনেছি, তাঁদের বক্তব্য আমরা সংবাদপত্রে দেখেছি, কিন্তু আমি বিশ্বাস করি পশ্চিম পকিস্তানের গণতান্ত্রিক মানুষ যাঁরা আছেন তাঁরা বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের সঙ্গে একতাবদ্ধ হয়ে আগের দিনে যেমন বহু লড়াই করবার চেষ্টা করেছেন তাঁরা তা করবার চেষ্টা কাবেন। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ, তাঁরা সবাই ভুট্টো নন, ইয়াহিয়া নন বা সবাই মিলিটারী গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত নন, তাঁরা সাধারণ মানুষ- মজুর, কৃষক, মধ্যবিত্ত, মেহনতী মানুষ তাঁরা নিশ্চয়ই বাংলাদেশের মানুষের এই স্বাধীনতার লড়াইকে সমর্থন করবেন, পৃথিবীর গণতান্ত্রিক মানুষের সঙ্গে এক হয়ে। এ থেকে আমাদেরও কিছু শিক্ষার আছে। অনেক সময় আমরা দেখেছি, পৃথিবীতে এটা হয়েছে, এটা নতুন নয়, দুঃখজনক হলেও এ ঘটনা ঘটেছে যে, পার্লামেণ্টারি ডেমোক্রেসি সংসদীয় গণতন্ত্রে ভোট বা জনমত পদদলিত হয়েছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের মানুষ রায় দিয়ে যা চাইলেন তাঁরা তা পাননি। কারণ শাসকগোষ্ঠী, ঐ শাসকগোষ্ঠী, যারা জমিদারদের প্রতিনিধিত্ব করে, পুঁজিপতিদের প্রতিনিধিত্ব করে যা মুষ্টিমেয় লোকের প্রতিনিধিত্ব করে তারা তা করতে দেয়নি। ইতিহাসে আমরা দেখেছি জনমতকে তারা পদদলিত করেছে। এখানেই সেই একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি আমরা দেখতে পেলাম, বিশেষ করে পাকিস্তানে যা যা ঘটছে তার মধ্যে দিয়ে। সেখানে জনমত সুস্পষ্ট। এটা মুখ্যমন্ত্রী মহাশয় ঠিকই বলেছেন যে, এ রকম রায়, এত সংখ্যায়, এ সংসদীয় গণতন্ত্রে খুব কমই দেখা যায় তারা যে সুস্পষ্ট রায় দিয়েছেন তাতে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই, তথাপি আমরা দেখেছি যে, সমস্ত কিছু পদদলিত হয়ে গেল। শুধু পদদলিত হল না, সেখানে মিলিটারির অতর্কিত আক্রমণ হল, আকাশপথে, স্থলপথে, সমুদ্রপথে, বিভিন্ন দিক থেকে সে আক্রমণ সেখানে শুরু হল তখন আর কোন উপায় ছিল না, বাংলাদেশের মানুষ, পূর্ব পকিস্তানের মানুষের আর কোন পথ ছিল সেইজন্যই সেখানে তাদের স্বাধীনতার লড়াই, অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই সব এক হয়ে মিশে গিয়েছে। এ ছাড়া অন্য কোন পথ তাঁরা নিতে পারতেন না, অন্য কোন দিকে ও যেতে পারতন না, এইভাবে কোণঠাসা হয়ে। তাছাড়া তাঁরা প্রস্তুতও ছিলেন না এটা সুস্পষ্ট, তাঁদের নেতৃবৃন্দরা ও মনে করতে পারেন নি যে এরকম ঘটনা ঘটতে পারে। সেজন্য তাঁরা প্রস্তুতও ছিলেন না। কিন্তু ইতিহাস পর্যালোচনা করলে বারবার এ জিনিস দেখি আমরা মার্ক্সবাদীরা একথা বারবার বলেছি যে, সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণ থেকে আক্রমণ আসে না, আক্রমণ আসে শাসকগোষ্ঠী থেকে, যাঁরা মুষ্টিমেয়র প্রতিনিধিত্ব করেন। বাংলাদেশেও সেই একই জিনিস ঘটছে, এখানেও আমরা মিলিটারির আক্রমণ দেতে পাচ্ছি। জানি না, কত সংখ্যক মানুষ নরনারী, শিশু, বৃদ্ধ, যুবক সেখানে জীবন দিয়েছেন, এর কোন হিসাব-নিকাশ পাওয়া যাচ্ছে না এমন কি বর্ডার পেরিয়ে যাঁরা এখানে আসতে পেরেছেন এবং এখানে এসে বিবৃতি দিয়ে বা আলোচনা করে যা বলেছেন তাতেও তাঁরা সবটা যে জানেন তা নয়। কিন্তু তার ভয়াবহতা ওঁরা নিজেরা দেখে এসেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলা থেকে তাঁরা এসেছেন। আমাদের সঙ্গে তাঁদের আলোচনায় তাঁরা যে বিবরণ দিয়েছেন তা থেকে আমরা বুঝতে পারছি যে, কি ধরনের নারকীয় ঘটনা সেখানে ঘটেছে এবং এই অবস্থার মধ্যে পাকিস্তানের যে শাসকগোষ্ঠী, মিলিটারিতে যে গোষ্ঠী আছেন তাঁরা মনে করেছেন যে, তাঁরা জয়ী হয়েছেন। তবে হ্যাঁ, কিছু স্থান এখানে-ওখানে তাঁরা পুনর্দখল করেছেন। যাঁরা স্বধীনতার জন্য লড়াই করছেন তাঁদের পক্ষ থেকে এখনও সেখানে আছেন। সেজন্য তাঁরা জনেন যে, শুধু মিলিটারি কোন সলিউশন তা নয়। সে সমাধান শুধু মিলিটারি দিয়ে হবে না, এটা সেই মিলিটারি গোষ্ঠী ভালো করে জানেন। একটা জাতিকে মিলিটারি দিয়ে পিষে মারা যায়, শ্মশানে পরিণত করা যায়। কিন্তু আজ না হয় কাল আবার যখন সেখানে মানুষের উত্থান হবে তখন সেই মিলিটারিকে তাঁরা খতম করবে- এটাও সেই মিলিটারি গোষ্ঠি, যারা সেখানে শাসন চালাচ্ছে তারা জানে। সেজন্য তারা কি চেষ্টা করছে? আমরা দেখছি যে, তারা আবার সেখানে নতুন করে দালাল তৈরি করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু কাউকে খুঁজে পাচ্ছে না। আজ না হয় কাল কাউকে বসাতে হবে, শুধু মিলিটারি দিয়ে রাজত্ব করা যাবে না। আমরা কি দেখছি? আমরা দেখছি