পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১০১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭৬

 প্রতিদিনের ব্যস্ত বিপণী কেন্দ্র নিউমার্কেট এলাকা সেদিন একেবারে চুপচাপ। দুপুরের মধ্যে পাকসেনারা পোর্টের দিক থেকে বরফকল সড়ক হয়ে এখানে পৌঁছে যায় এবং সদরঘাট, রেলওয়ে ষ্টেশন এবং ষ্টেডিয়ামের দিকে তারা অগ্রসর হতে থাকে। ছোট একটি দল কোর্ট হিলের দিকেও পা বাড়ায়। কিন্তু হিলে অবস্থানরত আমাদের সৈন্যদের বুলেট বৃষ্টিতে পাকিস্তানীদের পিছু হটে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে হয়।

 একই দিন হালিশহরেও সকাল ৮টা থেকে সংঘর্ষ চলতে থাকে পাকিস্তানিরা মরিয়া হয়ে কামান দেগে চলছিলো। নৌ-বাহিনীর সবগুলো কামানই তখন সক্রিয় ছিলো ক্রমাগত দীর্ঘ ৬ঘণ্টা যাবত তারা হালিশহরের ওপর গোলাবর্ষণ করে। কামানের ছত্রছায়ায় শত্ররা হালিশহরের দিকে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা চালায়। কিন্তু ইপি-আর সেনাদের দুঃসাহসী পাল্টা আক্রমনের মুখে অগ্রগতি লাভে ব্যার্থ হয়ে শত্রুরা বিমান বাহিনীর সাহায্য প্রার্থনা করে। আধ ঘণ্টার মধ্যে দুটি বিমান চলে আসে। এবং বেলা সড়ে বারোটা থেকে আমাদের অবস্থানের উপর ক্রমাগত বিমান হামলা চালাতে থাকে। আমাদের কোন বিমানবিধ্বাংসী হাতিয়ার ছিলো না। সেই সময় নিজেদের কোন বিমান থাকারও কথা নয়। তাই শত্রু বিমানগুলো আকাশে তাদের পূর্ন আধিপত্য বিস্তার করে নির্বিঘ্নে আমাদের ওপর বোমা বর্ষণ করতে থাকে। তারা তাদের ইচ্ছেমতো রনাঙ্গনের ওপর আঘাত হানতে থাকলো। পরিস্কার রৌদ্রকরোজ্জল দিনে শত্রুর বিমানগুলো একটার পর একটা ট্রেঞ্চ দেখে দেখে ষ্ট্যাম্পিং করে চলছিলো। আমাদের বীর সেনানিরাও প্রাণপনে ঘাটি আকড়ে লড়াই করতে থাকলো। লড়াই করতে করতে অনেকেই ট্রেঞ্চের মধ্যে মৃত্যুবরন করলো। আহতও হলো অনেক। কিন্তু অবিরাম বোমা বর্ষনের ফলে তাদের অপসারণ করাও সম্ভব হয়ে ওঠেনি। যুদ্ধরত বাকী সৈন্যরাও বুঝতে পারলো তাদের আর বেশীক্ষন হালিশহর রক্ষা করা সম্ভব হবে না। গোলাগুলির মজুতও নিঃশেষ প্রায়। তারা রাইফেলের ওপর বেয়োনেট লাগিয়ে নিচের শত্রুদের সাথে হাতাহাতি লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হলো।

 বিকালের মধ্যে শত্রুরা হালিশহর দখল করে নিলো। হাতাহাতি যুদ্ধ চলছিলো আধঘণ্টার মতো। শত্রুসৈন্য সংখ্যাধিক্যের ফলে চুড়ান্ত ফলাফল কি হবে তা বোঝা গিয়েছিলো। আমাদের সৈন্যরা পেছনে এসে ঢাকা-চট্টগ্রাম সড়কের একস্থানে অবস্থান গ্রহন করলো। সহযোগীদের লাশও ফেলে আসতে হলো।

 হালিশহর পতনের পর শত্রুদের পুরো দৃষ্টি পড়লো কোর্ট হিলের ওপর। এটাই ছিলো শহরে আমাদের সর্বশেষ ঘাটি, সর্বশেষ আশা। বিভিন্ন দিক থেকে অবস্থানটির ওপর কয়েকবারই হামলা হলো। কিন্তু প্রতিবারই আমাদের সৈন্যরা তা প্রতিহত করে! এরপর এলো ট্যাংক বহর। অগ্রবর্তী ট্যাংকটি পাকা রাস্তা বেয়ে ওপরের দিকে উঠতেই আমাদের সৈন্যদের ট্যাংকবিধ্বংসী শেলের আঘাতে তা অকেজ হয়ে পড়লো। ট্যাংকটি অকেজো হয়ে থেমে পড়লে পেছনে অন্যান্য ট্যাংক এবং পদাতিক সৈন্যরা কিছুটা থমকে দাড়ালো। এ সময় সম্ভবত আমাদের শক্তির পরিমাপ করছিলো। ইতিমধ্যে অবশ্য শত্রুপক্ষ আমাদের দুর্বলতা বুঝতে পেরেছিলো। আমাদের সৈনিকদের তখন গোলাবারুদ নিঃশেষ প্রায় এবং বাইরের সাথে সকল প্রকার সংযোগও প্রায় সম্পূর্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিলো। অদুর ভবিষ্যতে নতুন করে কোনো সাহায্য লাভের সম্ভাবনাও ছিলো না।

 ২রা এপ্রিল ভোরে শত্রুরা আবার হামলা শুরু করলো। হামলা ছিলো সুপরিকল্পিত। মাত্র ৩০জন সৈনিকের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশ নিয়েছিলো পাকিস্তানীদের পুরো একটি ব্যাটালিয়ন। দুটি কোম্পানী মিলে প্রথম আঘাত হানলে তা সাফল্যের সাথে প্রতিহত করা হয়। এরপর আরো জোরদার হামলা চলতে থাকে। দুটি সংরক্ষিত কোম্পানী এবার অন্য দিক থেকে আক্রমন শুরু করে। মারাত্মক গুলিবর্ষণের ছত্রছায়ায় এরা একটু একটু করে পাহাড় বেয়ে উপরের দিকে উঠতে থাকে। এদিকে আমাদের প্রতিরোধকারী সৈন্যদের গোলাগুলি নিঃশেষ হয়ে যায়। একমাত্র ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্রটিও অকেজো হয়ে পড়ে। পদাতিক বাহিনীর আগে আগে এ সময় দুটি ট্যাংক উপরে উঠে আসে। বলতে গেলে অলৌকিকভাবে সেদিন আমাদের সৈনিকদের প্রায় সবাই সে অবস্থান ত্যাগ করে আত্মরক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলো। এভাবেই কোর্ট হিলের পতন ঘটলো এবং সাথে সাথে অনির্দিষ্টকালের জন্য চট্টগ্রাম নগরীও আমাদের হাতছাড়া হয়ে গেলো। তখন সময় ছিলো বেলা সাড়ে ১২টা। মাত্র ৩০জন ইপি-