পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৮৫

 মিজোদের কয়েকটি ছোট ছোট দল কোনক্রমে কয়েকটি টিলা পেরিয়ে পাহাড়ের ওপর সুবিধাজনক স্থান দখল করে নেয়। এদের এই জায়গা থেকে আমাদের অবস্থান এবং রামগড় অভিমুখী সড়ক পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো।

 যুদ্ধ পরিস্থিতি ক্রমেই সঙ্গীন হয়ে ওঠে। আমাদের সৈন্য সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বেশি শত্রুসৈন্য বাঙ্গালী সৈন্যদের প্রায় ঘিরে ফেলে। তরুন অফিসার ক্যাপ্টেন কাদেরকে আমরা এখানেই হারাই। প্রচণ্ড ঝুকি নিয়ে একটা সুবিধাজনক স্থান দখল করার জন্য সে এগিয়ে গিয়েছিলো যাতে বাঙ্গালী সৈন্যদের নিরাপদ পশ্চাদপসরণে সে সাহায্য করতে পারে। কাদের সফল হয়েছিলো, কিন্তু তারপরই লাইট মেশিনগানের এক ঝাক গুলিতে তার দেহ ছিন্ন বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। বীরের মত মৃত্যু বরণ করেছিলো ক্যাপ্টেন কাদের। এই যুদ্ধে প্রথম একজন অফিসার হারিয়ে আমাদের সৈন্যদের মনবল ভেঙ্গে পড়েছিলো। দু'জন মাত্র শওকত ও ফারুক (পরে দুজনই সেনাবাহিনীতে কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার হয়েছিলেন। এবং সিপাই ড্রাইভার আববাস শত্রুদের গুলিতে বৃষ্টির মধ্যে দিয়েই ক্যাপ্টেন কাদেরের দেহ উদ্ধার করে আনে। রামগড়ে আমরা যথাযোগ্য ধর্মীয় ও সামরিক মর্যাদায় কাদেরের মৃতদেহ দাফন করি।

 এপ্রিলের ২৯ তারিখে হিয়াকুর কাছে যুদ্ধ শুরু হয়। আমাদের অবস্থানস্থলের সামনের জায়গাটি ছিলো খোলা, কিন্তু দু'পাশে ছোট ছোট টিলার ওপর ঘন জঙ্গল। এই জঙ্গলের আড়াল দিয়ে শত্রুরা আমাদের পেছনে চলে আসতে পারতো। সে পরিস্থিতিতে সরবরাহ ঘাটি রামগড় থেকে আমাদেরকে সম্পূর্ন বিচিছন্ন হয়ে পড়তে হতো। আমাদের কাছে তখন রান্না করার মত কিছু ছিল না। অধিংকাশ খাবারই আসত রামগড় থেকে। দিনটি ছিল পরিস্কার। ভোর থেকেই আমাদের অবস্থানের ওপর মর্টার সেলিংয়ের মাধ্যমে কয়েক দফা হামলা হয়। বোমাবর্ষনের ছত্রছায়ায় আমাদের দিকে অগ্রসরমান শত্রুর অগ্রভাগে ছিলো প্রায় দুইশত স্থানীয় দালাল। খোলা মাঠ দিয়ে দুই কোম্পানী পাকসেনা এগিয়ে আসছিলো ওরা একশত গজের মধ্যে আসতেই আমাদের অস্ত্রগুলো গর্জে উঠলো। এই আকস্মিক হামলায় মুহুর্তের মধ্যে ওরা ভয় ও আতংকে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত হয়ে ছড়িয়ে পড়লো। দীর্ঘ দুই ঘণ্টার অবিরাম লড়াইয়ে আমাদের কয়েকজন হতাহত হবার পর অবশেষে আমাদের সৈন্যদেরকে চিকনছড়ার দিকে পশ্চাদপরসণ করার নির্দেশ দেয়া হলো।

 হিয়াকুর পতনের পর রামগড়ের পতন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠলো। সবচাইতে বিপজ্জনক ব্যাপার ছিলো শত্রুরা আমাদের অসামরিক ব্যাক্তিদের বিশেষ করে বড় বড় শরনার্থী দলের ভারত গমনের পথ প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিলো। সে সময়ে প্রতিদিন হাজার হাজার লোক ধুলিময় রাস্তা ধরে নারায়ণহাট থেকে হিয়াকুর এবং তারপর রামগড় হয়ে ফেনী নদী পেরিয়ে সাবরুমে গিয়ে আশ্রয় নিচিছল। কিন্তু হিয়াকুর পতনের পর সে পথ বন্ধ হয়ে গেলো।

 করেরহাটের পতনের পর বুঝতে পারি বর্তমান ধারায় যুদ্ধ করে আমরা কিছুই করতে পারবো না। আমরা আমাদের বাহিনীকে সুসংগটিত করে তুলতে পারছিলাম না। এই বাহিনীতে ছিলো বিভিন্ন ধরনের লোক ইপি আর পুলিশ আনসার, মুজাহিদ, সামরিক বাহিনীর লোক এবং মাত্র সপ্তাহ খানেকের ট্রেনিংয়ের পর রণাঙ্গনে নামিয়ে দেয়া নতুন মুক্তিযোদ্ধা। এইসব দলের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ শৃঙ্খলার অভাব ছিলো আমাদের বিপর্যয়ের একটি কারণ। আমাদের সকল সৈন্যকে একটা নিরাপদ শিবিরে নিয়ে তাদের জন্য বিশ্রাম ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন হয়ে পড়েছিলো। তাহলে তাদেরকে নিয়েই আবার একটা সংঘবদ্ধ ও সুসংগঠিত বাহিনী গড়ে তোলা যেতো। আমাদের অধিকাংশ সৈন্যকেই ইতিমধ্যে অপুষ্টিরও শিকার হয়ে পড়তে হয়েছিলো।

 সেই উদ্দেশ্যে ভারতীয় সীমানার ছয় মাইল ভেতরে হরিনায় একটা গোপন শিবির স্থাপন করা হয়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের থেকে আমরা কয়েকটি তাবু পেয়েছিলাম। রামগড় থেকে কিছু কিছু জিনিস এখানে