পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৯০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৬৫

 ২৫শে মার্চ রাত প্রায় ১ টায় কর্নেল মাসুদুল হাসান খান ঢাকা থেকে টেলিফোন করে জিজ্ঞেস করেন যে তোমাদের অবস্থা কি? ঢাকাতে তো বেশ গুলিগোলার আওয়াজ শুনছি। এই টেলিফোন পাবার পরপরই ঢাকার সাথে সামরিক-বেসামরিক সমস্ত যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়। ঢাকায় যে তখন কি হচ্ছিল তার কোন খবরই আমরা পাচ্ছিলাম না। ২৬শে মার্চ সকাল বেলায় ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার রকিবকে বললাম যে গত রাতে যা কিছু ঘটনা ঘটেছে এবং চারিদিকে যে সমস্ত গুজব রটছে তার পরিপ্রেক্ষিতে একটা উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ বিরাজ করেছে। এ মুহূর্তে এ ব্যাপারে আমাদের চিন্তা-ভাবনা করা উচিত। যেহেতু ঢাকার সাথে অন্য সব রকম যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায় সেহেতু আমি অয়ারলেস সেটে গিয়ে ঢাকার কি হচ্ছে তা শোনার চেষ্টা করি। ২৫শে মার্চ রাতে টেলিফোন যোগাযোগ বিছিন্ন হবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত আমি ইউনিটে অয়ারলেস সেটে যেভাবে কাজ চলছিল তার একটি বিস্তৃত বর্ণনা নিচে দেওয়া গেলঃ-

 বিগ্রেড হেডকেয়ার্টারে - ৫৭ বিগ্রেডে ছিল কণ্ট্রোল স্টেশন আর সাব-স্টেশন ছিল নিন্মলিখিত ইউনিটগুলোঃ ১। ১৮ পাঞ্জাব, ২। ৩২ পাঞ্জাব, ৩। ২২ বেলুচ রেজিমেণ্ট, ৪। ১৩ ফ্রণ্টিয়ার ফোর্স রেজিমেণ্ট, ৫। ৩১ ফিল্ড রেজিমেণ্ট, ৬। ৪৩ লাইট এণ্টিএয়ারক্র্যফট রেজিমেণ্ট, ৭। ট্যাংকস স্কোয়াড্রন- এগুলো সব ঢাকায় ছিল, ৮। ২ ইস্ট বেঙ্গল, জয়দেবপুর, ৯। ২ ইস্ট বেঙ্গল, টাঙ্গাইল (এ সেটগুলো ঢাকা থেকে এসেছিল)। এর অপারেটর সব পাঞ্জাবী ছিল। অয়ালেস সেট এবং অয়ারলেস নেট কিভাবে কাজ করে সে সম্বন্ধে যারা পুরোপুরি অবগত নন তাদের অবগতির জন্য বলছি যে, অয়ারলেস নেট-এ একই ফ্রিকোয়েন্সিতে যখন এক স্টেশনে কথা বলা হয়, তখন অন্য স্টেশনের লোকজন একই সময়ে ঐ সমস্ত কথাবার্তা শুনতে পায়।

 ২৬ শে মার্চ সকাল ৭/৮ ঘটিকার সময় আমি এবং কর্নেল রকিব অয়ারলেস সেটে যাই। সেটটা জয়দেবপুর রাজবাড়ির অফিসার্স মেস-এর পূর্বদিকে বসানো ছিল। আমরা যখন সেটে যাই তখন সেটে কথা হচ্ছিল। আমরা সেখানে পৌঁছার সাথে সাথে অপারেটর ফ্রিকোয়েন্সি পরিবর্তন করে অন্য চ্যানেলে চলে আসে। ফ্রিকোয়েন্সিতে পরিবর্তন করাতে অন্যান্য স্টেশনের সাথে আমাদের যোগাযোগ বিছিন্ন হয়ে যায়। আমি অপারেটরকে (পাঞ্জাবী ছিল) জিজ্ঞেস করি যে তুমি ফ্রিকোয়েন্সি কেন চেঞ্জ করছ? আর বাকী স্টেশন কোথায়? সে উত্তর দিল যে ঢাকা থেকে নির্দেশ দিয়েছে গোলযোগপূর্ণ আবহাওয়ার জন্য এবং এই নেটে অনেক স্টেশন হয়ে যাবার জন্য। জয়দেবপুর-ঢাকা-টাঙ্গাইল এক নেটে থাকবে বলে নির্দেশ পাওয়া গেছে। আমি তাকে বললাম কিছুক্ষণ আগে অয়ারলেস সেট যে ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল সে ফ্রিকোয়েন্সিতে ফিরে যাও। সে উত্তর দিল যে, স্যার আমার সেট আর কোন ফ্রিকোয়েন্সিতে ছিল না। আমি তখন তাকে বললাম যে অন্যান্য ইউনিট যে ফ্রিকোয়েন্সিতে আছে সে ফ্রিকোয়েন্সিতে মিলাও বা সেট কর। সে উত্তর দিল “আমার সে ফ্রিকোয়েন্সি জানা নেই।” আমি তাকে আর কিছু না বলে কর্নেল রকিবের সাথে অফিসে ফিরে আসি। আসার সময় রাস্তায় কর্নেল রকিবকে বলি, “There must have something serious happened in Dacca. That is why Dacca station does not want us to hear the conversation” তারপর আমি একজন বাঙ্গালী অপারেটরকে গোপনে নির্দেশ দিই ঐ সেট এর উপর লক্ষ্য রাখার জন্য যে কি কথাবার্তা হয়। আমি অফিস যাবার সাথে সাথে আমাদের ব্যাটালিয়নের নিজস্ব অপারেটর আমাকে বলে যে ময়মনসিংহের কোম্পানী কমাণ্ডার মেজর নুরুল ইসলাম আপনার সাথে জরুরী কথা বলতে চান। টেলিফোন যোগাযোগ ছিল না বলে তিনি অয়ারলেসে কথা বলতে চান। ময়মনসিংহে আমাদের নিজস্ব অয়ারলেস সেট ছিল। আমি সেটে যাবার পর মেজর নুরুল ইসলাম বলে যে, সে কয়েক হাজার লোক দ্বারা ঘেরাও হয়ে আছে। তারা বলছে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেণ্ট তাদের সাথে যোগ দিক।

 এখানে বলে রাখা দরকার ময়মনসিংহ ইপিআর হেডকোয়ার্টারে মেজর নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে আমাদের এক কোম্পানী সৈন্য ছিল। ইপিআর-এর উইং কমাণ্ডার একজন পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসার ছিল। ইপিআর উইংয়ে তাদের যে রিজার্ভ কোম্পানী ছিল তার প্রায় অধিকাংশই বাঙ্গালী ছিল। উইং কমাণ্ডার ঢাকার নির্দেশমত সমস্ত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈনিকদের (ইপিআর) বর্ডার থেকে উইথড্র করে উইং হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে। তাদের সংখ্যা উইং হেডকোয়ার্টারে ছিল প্রায় ৫০/৬০ জন। জনতা যখন উইং হেডকোয়ার্টার ঘিরে ফেলল তখন