পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/১৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৬৬

 হেডকোয়ার্টার-এর আউটার পেরিমিটারে বাঙ্গালী সৈনিকরা পাহারারত অবস্থায় ছিল। মেজর নুরুল ইসলাম (বর্তমানে লেঃ কর্ণেল) মাইক্রোফোনে উচ্চস্বরে জনসাধারণকে এ এলাকা থেকে চলে যাবার নির্দেশ দিচ্ছিলেন এবং এও আশ্বাস দেন যে, সময় আসলে আমরা আপনাদের নিরাশ করব না। সারাদিন তারা এ অবস্থায় ঘেরাও ছিল। মেজর নুরুল ইসলামের আশ্বাস পেয়ে জনতা আস্তে আস্তে সরে যায়। আমাকে যখন সে এ সমস্ত ঘটনা জানায় তখন আমি তাকে বললাম ধীরেসুস্থে কাজ কর। সময় আসলে সব কিছু বলব। সে আমাকে সেখানে আরো কিছু সৈনিক পাঠাবার জন্য অনুরোধ জানাচ্ছিল। আমি তাকে আশ্বাস দিয়েছিলাম যে আমি পাঠাতে চেষ্টা করব।

 আমি অয়ারলেস থেকে অফিসে ফিরে আসার সাথে সাথে আমি যে একজন অপারেটরকে ঠিক করেছিলাম ঐ অয়ারলেস সেটে লক্ষ্য রাখার জন্য সে এসে আমাকে খবর দিল যে, স্যার, আপনারা চলে আসার কিছুক্ষণ পর সে আবার ফিকোয়েন্সি চেঞ্জ করে অন্যান্য স্টেশনের কথা শুনছিল। আমি দূর থেকে শুধু এতটুকুই শুনতে পেরেছি কে যেন কতগুলো লোক মেরেছে। পাঞ্জাবী অপারেটর তার সম্বন্ধে নির্দেশ চাইলে ঢাকার অপারেটর ভীষণভাবে রাগান্বিত হয়, এবং বলে সে যেন আর কখনো এই ফ্রিকোয়েন্সিতে না আসে। তাকে গতকাল যেভাবে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে সে যেন সেভাবে চলে।

 এ খবর পেয়ে আমি ব্যাটালিয়ান কমাণ্ডার কর্নেল রকিবের অফিসে যাই এবং তাকে এ সমস্ত ব্যাপার (ময়মনসিংহের ব্যাপার এবং অয়ারলেস-এর ব্যাপার) সব খুলে বলি। এবং তাকে আমি বলি যে, স্যার, আমাদের এখন কিছু একটা করা দরকার। তা না হলে পরিস্থিতি আমাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যেতে পারে। যদি চলে যায় আপনিও কিছু করতে পারবেন না, আমিও কিছু করতে পারবো না। তিনি তখন আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কি করা দরকার? আমি এ পরামর্শ দিলাম যে ময়মনসিংহের পরিস্থিতি খারাপ। ঢাকার সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই। এই পরিস্থিতিতে ময়মনসিংহের সাহায্যের জন্য আমাদের সমস্ত সৈনিকদের নিয়ে সেখানে চলে যাই। আমার উদ্দেশ্য ছিল, আমাদের সৈনিকদের ময়মনসিংহ গিয়ে কনসেনট্রেট করা। আর পরিস্থিতি লক্ষ্য করে যদি কিছু করতে হয়, তাহলে আমরা যেন এক সাথে হয়ে করতে পারি। তিনি তখন বললেন, ঢাকা থেকে নির্দেশ ছাড়া কি ভাবে এ পদক্ষেপ নিই। আমি তখন বললাম যে, আপনি ঢাকা থেকে নির্দেশ নেন যে ময়মনসিংহের পরিস্থিতি খুবই খারাপ, আমাদের সেখানে ইনফোর্সমেণ্ট পাঠানো দরকার। তিনি আমার কথামত ঢাকাতে অয়ারলেস সেটে কথা বললেন। কিন্তু কোন উত্তর পেলেন না। আমি তাকে বললাম যে এখন আমরা যদি কিছু না করি তাহলে আমাদের সৈনিকদের নিরাপত্তার জন্য আমাদের যে দায়িত্ব রয়েছে তা হয়ত আমরা পালন করতে পারব না। এতে তিনি একটু ঘাবড়িয়ে পড়লেন। ২৬ শে মার্চ প্রায় দশটার দিকে জেনারেল টিক্কা খান তৎকালীন সারা পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক আইন জারী করেন এবং ঐ আইনের নির্দেশাবলী রেডিওতে প্রচার করতে থাকেন। সামরিক আইন জারীর কথা শুনে সৈনিকদের মধ্যে এক উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। ঢাকায় যে বেশকিছু একটা ঘটেছে তার একটা আভাস পাওয়া যায়।

 ২৬ শে মার্চ সকাল ১০/১১ টার দিকে দেখলাম একটা আর্মি হেলিকপ্টার রাজেন্দ্রপুরের দিকে একবার যাচ্ছে এবং আবার আসছে। খবর নিয়ে জানতে পারলাম তারা রাজেন্দ্রপুর থেকে এ্যামুনিশন নিচ্ছে। তাতে বুঝা যাচ্ছে ঢাকাতে যে এ্যামুনিশন ছিল তা এত তাড়াতাড়ি কিভাবে তারা খরচ করল। এ খবর পাবার পর ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডারকে আবার বললাম যে, স্যার, “There must have something serious happened in Dacca and that is why they are running short of ammunition is being lifted by helicopter."

 ২৭শে মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকাতে কি ঘটেছিল তার কোন খবর পাইনি। বিকেলের দিকে আমাদের একজন ড্রাইভার ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। সে খবর দিল যে ঢাকাতে বেশ গোলাগুলি হয়েছে এবং বেশকিছু লোক মারা গিয়েছে। সে আরো বললো যে, বাঙালী সৈনিকদের বেঁধে নিয়ে কোথাও নিয়ে মেরে ফেলা