পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৯০

বেলা দুটো-আড়াইটার দিকে এবং সন্ধ্যার দিকে ফিরে আসে। সে জানায় যে, টঙ্গীতে পাক আর্মি তাকে বিশ্বাসই করতে চায় না, তাকে এবং তার সঙ্গের সবাইকে ‘ডিস আর্ম' করে জিজ্ঞাসাবাদ করে, এমনকি তার পাঞ্জাবীতে কথা বলার উপরে সন্দেহ প্রকাশ করে।

 যাই হোক, ঐ অফিসার জায়দেবপুর থেকে টঙ্গী রওনা হয়ে যাওয়ার পর কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম নিতে উপরে নিজের কামরায় গেলাম। কিছু সময় পরে মেজর মইন আমার কামরায় এসে বেলন যে, আমাদের প্ল্যান নাকি পাঞ্জাবী এবং অবাঙালীদের কাছে ফাঁস হয়ে গিয়েছে, অথবা তারা আঁচ পেয়ে গিয়েছে। কারণ হিসেবে বলল যে, আমাদের কোন সেপাই ক্যাণ্টিনের কিছু পাঠান সিভিলিয়ানকে প্রকারান্তরে বলে ফেলেছে ঐ রাত্রে সাবধান থাকতে, এবং সে কথা তাদের ভিতরে ছড়িয়ে পড়েছে। আমি তাকে আশ্বস্ত করে বললাম আরও সাবধান হয়ে যেতে এবং আমি ভাবছি এ ব্যপারে কি করা যায়। এর কিছুক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন আজিজ আমাকে এসে বললেন যে, একজন স্থানীয় ছাত্রনেতা আমার সঙ্গে টেলিফেনে কথা বলতে চায় এবং দেখা করতে চায়। আমি অল্পক্ষণ পরেই আসছি বলে দিতে বললাম (প্রসঙ্গত বলা যেতে পারে যে, যদিও ঢাকার সঙ্গে আমাদের টেলিফোন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল তবুও জয়দেবপুরে স্থানীয় এক্সচেঞ্জ কাজ করছিল এবং গাজীপুর ফ্যাক্টরী পর্যন্ত আমাদের যোগাযোগ ছিল) এই মনে করে যে ছাত্রনেতার সঙ্গে ‘ইউনিফর্ম পরিহিত অবস্থায় দেখা করা হয়ত ঠিক হবে না এবং আমাদের ভিতরকার অবাঙালীদেরকে প্রকারন্তরে ভাব দেখানো যে কোন কিছু অঘটন ঘটতে যাচ্ছে না, আমি ‘ইউনিফর্ম' না পরে একটা প্রাইভেট শার্ট এবং প্যাণ্ট পরে নীচে নেমে আসলাম। ঐ ছাত্রনেতার (তার নাম আমার এখন মনে নাই) সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলে সন্ধ্যার সময় গেটের সামনে দেখা করার সময় দিলাম। নীচে নেমে আসার পর থেকে প্রাইভেট পোশাকেই সুবেদার নূরুল হক এবং অন্যান্য সকলের সঙ্গে ‘ডিটেলস টাই আপ' অর্থাৎ খুঁটনাটি বিষয়ে নির্দেশাদি দিতে ব্যস্ত ছিলাম। এ সময় আমি যথেষ্ট চিন্তকুল এবং উদ্বিগ্ন ছিলাম। কারণসমূহ ছিল (১) মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল পৌঁছেছেন কিনা এবং আগে কি করেছেন তার তখন পর্যন্ত পাই নাই, (২) ময়মনসিংহ কোম্পানীর সঙ্গে সকাল থেকে যোগাযোগ বিছিন্ন, (৩ আমাদের প্ল্যান যদি খোদা-না-খাস্তা সফল না হয়ে তাহলে পরিণতি কি, (৪) বিদ্রোহহের ভবিষ্যৎ কি, এবং (৫) আমার ফ্যামিলি এবং ছেলেরা যারা ক্যাণ্টনমেণ্ট আছে তাদের ভাগ্যে আগামীকাল থেকে কি পরিণতি ইত্যাদি। আমার এই চিন্তাযুক্ত ভাব দেখে হয়ত কেউ সন্দেহ প্রকাশ করলেন আমি তাদের সঙ্গে যাব কিনা। আমি তাদেরকে উত্তরে বললাম যে, সব কিছু প্ল্যান করে তো পিছনে থাকা যায় না, কারণ পরিত্রাণ পাওয়া যাবে না। যাক, বেলা প্রায় ৪টার দিকে খবর পাওয়া গেল যে, মেজর শফিউল্লাহ টাঙ্গাইল অতিক্রম করে ওখানকার কোম্পানী সমেত ময়মনসিংহের পথে রয়েছেন। কিছু আশ্বস্ত হওয়া গেল।

 এখন আমাদের খেয়াল ‘লাষ্ট মিনিট কো-অর্ডিনেশন', বিশেষ করে রাজেন্দ্রপুরের প্লাটুন এবং গাজীপুরের কোম্পানীর সঙ্গে। ক্যাপ্টেন আজিজ যথেষ্ট জীবনের ঝুঁকি নিয়ে রাজেন্দ্রপুরের প্লাটুনকে বলে আসলেন সন্ধ্যার সময় তোকে তাদের অয়ারলেস খুলে রাখতে এবং ‘সাংকেতিক বাক্য' পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যেন তারা সেখানকার তার ডিঙ্গিয়ে নিজের বন্দোবস্তে বেরিয়ে পড়েন। এম্যুনিশন ডিপোতে ঢোকার উপর সব সময় কড়াকড়ি, এবং ঐ সময়ে খুব বেশী ছিল। ঐ জায়গার ও-সি বা অধিনায়ক ছিলেন এক অবাঙালী। ক্যাপ্টেন আজিজ তাকে যেয়ে বললেন যে, তিনি এসেছেন 'সামারী অব এভিডেন্স' রেকর্ড করতে। দুই রাত আগে যে দুইজন লোক আমাদের প্লাটুন থেকে পালিয়ে ছিল, তাদেরকে এ্যারেস্ট করে রাখা হয়েছে এবং সি- ও সাহেব আগামীকাল তাদের ‘সামারী কোর্ট মার্শাল' করবেন। ভিতরে ঢুকবার অনুমতি পাওয়া পর্যন্ত ক্যাপ্টেন আজিজের উপর স্টেনগান তাক কার ছিল। এইসব ঘটনাপ্রবাহে ঐ দিন গড়িয়ে সন্ধ্যা হয়ে যায়। সন্ধ্যার সঙ্গে সঙ্গে ওখানকার অফিসাররা উতলা হয়ে ওঠেন যাওয়ার সময় সংকেত দেওয়ার জন্যে। সন্ধ্যার সময় বা কিছু আগে খবর পেলাম আমাদের ময়মনসিংহ কোম্পানীর সঙ্গে অয়ারলেসে সংযোগ স্থাপন হয়েছে। ঐ কোম্পানী কমাণ্ডারকে নিজে সাংকেতিকভাবে জানিয়ে দিলাম যে মেজর শফিউল্লাহ তাদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার জন্যে টাঙ্গাইল ছেড়ে আরও এগিয়ে গেছেন, এবং আমরাও রওনা হচ্ছি। আমি সন্ধ্যাটা একটু গাঢ় হওয়ার অপেক্ষায় ছিলাম। ঐ দিন সন্ধ্যা থেকে ঐ অঞ্চলে