পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৪২

যে, যথাশীঘ্রই আমরা সব পাব। লেঃ কর্নেল চক্রবর্তী এত বেশী আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন যে, তখনই তিনি সাথে করে আনা একটা চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি দিতে চাইলেন। এটার ব্যবহারকৌশল আমাদের জানা ছিল না বলে তিনি আমাকে দুপুরের খাবারের পর নিয়ে গেলেন ওটার কৌশল শিখাবার জন্য। এমন সময় আমার সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে টেলিফোনে খবর আসল যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বড় দল ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এখানে একটু বলে রাখা ভাল যে, ৩রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমান হামলা চলাকালীন যশোর থেকে পাক সেনাবাহিনীর একটা দল অগ্রসর হতে গিয়ে কালীগঞ্জ এলাকায় আমাদের ফাইটিং পেট্রোলের এ্যামবুশে পড়ে কিছুসংখ্যক প্রাণ হারিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। যাই হোক, খবর পেয়ে আমি আমার একজন সৈনিককে ঐ চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি’র কৌশল শিখিয়ে ওটা নিয়ে আসবার জন্য ওখানে রেখে আমি সদর দপ্তরের দিকে দ্রুতগতিতে চলে আসি। সদর দপ্তরে তখন ছিলেন ডাঃ আসহাবুল হক সাহেব ও আমার স্ত্রী। এই খবরে স্বাভাবিকভাবেই ওরা একটু মুষড়ে পড়েছিল। যাই হোক, আমি যাবার পর প্রয়োজনীয় খবরাখবর ও সৈন্য মোতায়েন করার পর অবস্থা আয়ত্তে আসে। পাকিস্তানীরা আর অগ্রসর হয়নি। বুঝতে পারলাম এটা ছিল তাদের নকল আক্রমণের প্রহসন।

 জীবননগর থেকে চলে আসার পূর্বে লেঃ কর্নেল এইচ, আর, চক্রবর্তী আমাকে সবরকম আশ্বাস দিয়ে বললেন যে, অচিরেই আমরা আমাদের ভারী অস্ত্রাদি পাব, যার জন্য তিনি আমাকে আইজি-এর অফিসে মেজর বি, এন, ভট্টাচার্যের সাথে সর্বক্ষণ যোগাযোগ রাখার উপদেশ দিলেন। তাঁর নিজের টেলিফোন নাম্বারও দিলেন। সেই থেকে প্রতিক্ষণ ইণ্ডিয়ান বিএসএফ-এর আইজি সাহেবের অফিসে মেজর ভট্টাচার্যের কাছে টেলিফোনে সর্বশেষ সিচুয়েশন রিপোর্ট দিতাম এবং জীবন নগরে প্রস্তাবিত আমার জন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহের সর্বশেষ অবস্থা কি জানতে চাইতাম। তিনি আমাকে প্রতিবারই আশ্বাস দিয়ে বলতেন যে আমার ডিমাণ্ড দিল্লীর অফিসে বিবেচনাধীন আছে, শীঘ্রই এসে যাবে।

 এদিকে পাকিস্তান সেনাবহিনী যশোর থেকে ৬ই এপ্রিল ভোরবেলা আমার বিশাখালী সৈন্যাবস্থান আক্রমণ করে, কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিণতি কে এড়াবে! আমার বাহিনী সর্বতোভাবে প্রস্তুত ছিল, সতর্ক ছিল। এদের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হওয়ায় তাদের বহু প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি হয়, কেবল সামান্য কিছু লোক যশোর সেনানিবাসে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এটা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে আমাদের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ প্রথম বিজয়, যার জন্য আমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনসাধারণের মনের বিশ্বাস ও উদ্দীপনা আকাশচুম্বি অবস্থা গ্রহণ করে। আমিও এই সুযোগে আমার বাহিনীর অবস্থান সীমা পরিবর্তন করে কালীগঞ্জের দক্ষিণে যশোর সেনানিবাস থেকে ৫ মাইল দূরে অর্ধবৃত্তাকারে স্থাপন করি। ব্যাপকভাবে পেট্রলিংও কায়েম রাখি যার জন্য যশোরে পাক-বাহিনী বের হতে আর সাহস করেনি।

 অন্যদিকে জীবননগরের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আশ্বস্ত হয়ে আমি দর্শনা-গেদের রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী উঠিয়ে ফেলা রেললাইন জোড়া দিয়ে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রেল যোগাযোগ স্থাপন করি এবং ৭ই এপ্রিল অপরাহ্নে একটা লম্বা খালি মালবাহী ট্রেন গেদে স্টেশনে দাঁড় করিয়ে রাখি আমাদের ইপ্সিত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও পোলাবারুদ বহন করে নিয়ে আসার দুরাশায়। এটা যে সত্যি দুরাশা ছিল তখন ভেবে দেখার ফুরসত পাইনি, সন্দেহও হয়নি। এদিকে ৬ই এপ্রিলের পর থেকে তীব্র গতিতে চলতে লাগল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রি-ইনফোর্সমেণ্ট প্রোগ্রাম-জল ও আকাশপথে। আকাশপথে বাধা দিবার আমার কোন শক্তি ছিল না। জলপথেও বাধা দিতে পারিনি, কেননা যশোর সেনানিবাস থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণ দিকে খুলনা-মঙ্গলা বন্দর পর্যন্ত তখনও আমার আয়ত্তাধীন ছিল না।

 ইপিআর-এর ৫নং উইং-এ অবস্থান ছিল খুলনায়। তার কমাণ্ডার ছিল অবাঙ্গালী। তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে ইপিআর সেনাবাহিনীকে প্রায় পুরোপুরিভাবে নিরস্ত্র করে রেখেছিল। লড়াই লাগার সাথে সাথে