পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৬৮

হয়। উক্ত রেইডে আমরা মর্টার ব্যবহার করি। আমার ৪ জন সৈন্য আহত হয়। উক্ত রেইডে যথেষ্ট কষ্ট সহ্য করতে হয় আমাদেরকে, কেননা কাঁদামাটি এবং খালবিল পেরিয়ে আমাদের রেইড করতে হয়েছিল।

 ২৩শে এপ্রিল, ১৯৭১ (কাগজপুকুরের যুদ্ধ): ২৩শে এপ্রিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দুই ব্যাটালিয়ন সৈন্য কাগজপুকুর গ্রামে আমাদের মূল ঘাঁটির উপর আক্রমণ করে। তারা আর্টিলারীর সাহায্য নেয়। এখানে দীর্ঘ ছয় ঘণ্টা তুমুল যুদ্ধ চলে। আমি আমার সৈন্যদেরকে নিয়ে পরে বেনাপোল কাস্টম কলোনী ও চেকপোষ্ট এলাকায় বিকল্প প্রতিরক্ষা ব্যাবস্থা নিতে বলি। কাগজপুকুরের এ যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ৫০ জন সৈন্য নিহত হয় ও অনেক আহত হয়। আমার ২৫ জন সৈন্য শহীদ হয়। অনেক বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করায় বাংলাদেশ সরকার তাকে 'বীরবিক্রম' উপাধি প্রদান করেন।

 এর পরবর্তী পনের দিন ধরে শত্রুপক্ষ বেনাপোল কলোনী ও চেকপোস্ট এলাকা দখল করার জন্য বহুবার আক্রমণ করে। কিন্তু প্রত্যেকবারই তাদের আক্রমণের পাল্টা জবাব দিই এবং প্রতিহত করি। উক্ত পনের দিনের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রায় ১০০ জন সৈন্য নিহত হয়। এই আক্রমণের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বেনাপোল তারা দখল করে সেখানে পাকিস্তানী পতাকা উত্তোলন করবে। কিন্তু তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এবং বাংলাদেশের পতাকাই উড়তে থাকে। উপরন্তু এ এলাকা তারা কখনও দখল করতে পারেনি। বেনাপোলের যুদ্ধে আমার দশ জন সৈন্য শহীদ হন এ সংঘর্ষে হাবিলদার আবদুল হাই, হাবিলদার আবুল হাশেম (টি-জে), হাবিলদার মোহাম্মদ ইব্রাহীম, ল্যান্স নায়েক ইউসুফ আলী, ল্যান্স নায়েক মুজিবুর রহমান, সিপাই আবদুল মান্নান অভূতপূর্ব দক্ষতা ও সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করে অসীম বীরত্বের পরিচয় দেয়। বড়আঁচড়া গ্রামে এ্যামবুশ করে হাবিলদার ফয়েজ আহমদ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৫ জন সৈন্যকে নিহত করে।

প্রতিরোধ যুদ্ধে যশোর ও অন্যান্য এলাকা

যশোর রণাঙ্গণে

 ২৩ মার্চ তারিখে ইপিআর বাহিনীর জওয়ানরা তাদের ক্যাম্পে স্বাধীন বাংলার পতাকা তুলল, আর সেই পতাকার সামনে শ্রেণীবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ‘গার্ড অব অনার' দিল। অবাঙ্গালীরা প্রতিবাদ তুলেছিল, কিন্তু তাদের সেই আপত্তি টিকল না। ২৫শে মার্চ তারিখে ঢাকা শহরে ইয়াহিয়ার জঙ্গী-বাহিনীর বর্বর আক্রমণের খবর যখন এসে পৌঁছল, যশোরের মানুষ তাতে ভয় পাওয়া দূরে থাক, বিক্ষোভে ফেটে পড়ল, ক্রোধে গর্জন করে উঠল-এর উপযুক্ত প্রতিশোধ চাই। যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টে কামান, মর্টার আর মেশিনগানে সজ্জিত হাজার হাজার পাক সৈন্য মোতায়েন হয়ে আছে, যে- কোন সময় তারা অগ্নিস্রাবী প্লাবন নিয়ে নেমে আসতে পারে, এ কথা চিন্তা করেও তারা ভয়ে পিছিয়ে গেল। ২৬, ২৭ ও ২৮শে মার্চ, এই তিন দিনে ইপি-আর-এর চারটি ক্যাম্পে জওয়ানরা প্রতিরোধের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প নিল।

 প্রথমম সংঘর্ষ ঘটল ২৯শে মার্চ তারিখে শহরের উপর নয়, শহর থেকে বাইরে যশোর ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরে। সেদিন ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরে বেঙ্গল রেজিমেণ্টের এক ব্যাটালিয়ন সৈন্যকে নিরস্ত্র করা হয়েছিল। দিনের অবস্থা বদলে গেছে, মুক্তি আন্দোলনের হাওয়া ক্যাণ্টনমেণ্টের ভেতরেও এসে ঢুকেছে - নিরস্ত্র বাঙ্গালী সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করল। এর পরিণাম কি হবে, তা তারা ভাল করেই জানত, তা সত্ত্বেও এই লাঞ্ছনাকে তারা নিঃশব্দে মাথা পেতে মেনে নেয়নি।

 সতর্কতামূলক ব্যাবস্থা হিসেবে ওরা আগেই বেঙ্গল রেজিমেণ্টের ম্যাগাজিনের চাবিটা কেড়ে নিয়েছিল। বিদ্রোহীরা তাতেও দমল না, তারা ম্যাগাজিন ভেঙ্গে কিছু অস্ত্র বার করে নিয়ে এল। তার ক্যাণ্টনমেণ্টের

[১]


  1. 'প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ" গ্রন্থ থেকে সংকলিত।