পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/২৯৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
২৭৩

করে ফেলল। তার মিনিট কয়েক পরেই বিক্ষুদ্ধ বাঙ্গালী সৈন্যরা মরিয়া হয়ে বিদ্রোহ ঘোষণা করল এবং জোর করে তাদের নিজেদের অস্ত্রাগার দখল করে নিল।

 এবার দু'পক্ষে তুমুল যুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তান সৈন্যদের সংখ্যা বাঙ্গালীদের চেয়ে বহুগুণে বেশি। তাছাড়া কামান, মর্টার ইত্যাদি ভারী অস্ত্রশস্ত্র, সবকিছুই তাদের হাতে, ফলে এই যুদ্ধের পরিণতি যা ঘটা স্বাভাবিক তা'ই ঘটল। ঘণ্টাকয়েক ধরে এই যুদ্ধ চলেছিল। এই সংঘর্ষের ফলে ক্যাণ্টনমেণ্টের দু-তিন শ বাঙ্গালী সৈন্য মারা গেল। অবশিষ্ট বাঙ্গালী সৈন্যরা ছত্রভঙ্গ হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্ট ছেড়ে পালিয়ে গেল। যশোর জেলার মুক্তিসংগ্রামের এটাই হলো সূচনা।

 এই পালিয়ে আসা বাঙ্গালী সৈন্যদের মধ্যে কোন শৃঙ্খলা ছিল না, যে যেদিকে পারল সে সেই দিকে পালাল। আবদুর রউফ আর তাঁর সাথী দুইজন সৈন্য তাদের সবার মধ্য থেকে বিচিছন্ন হয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু এই বিচিছন্ন অবস্থাতেও তাঁরা তাঁদের মনোবল হারাননি। তাঁর এই তিনজনে মিলে নিজেদের একটা ইউনিট গঠন করলেন এবং শপথ নিলেন যে, তাঁরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম করে যাবেন। এই সঙ্কল্প নিয়ে তাঁরা যশোর শহরে ফিরে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করলেন। তখন যশোর শহর মুক্তিবাহিনীর অধিকারে এসে গেছে। মুক্তিবাহিনীতে যোগদানের পর থেকে আবদুর রউফ ও তাঁর দুইজন সাথী একই সঙ্গে লড়াই করে এসেছেন এবং আবদুর রউফ আহত হয়ে রণক্ষেত্র ছেড়ে চলে আসার আগ পর্যন্ত তাঁরা এক সঙ্গেই ছিলেন।

 ৩রা এপ্রিল তারিখে এক রক্তাক্ত যুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাক-সৈন্যরা যশোর শহর পুনর্দখল করে নিল। মুক্তিবাহিনী শহর ত্যগ করে নড়াইল গিয়ে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করল। কিন্তু যশোর শহর ছেড়ে গেলেও মুক্তিবাহিনীর একটা অংশ শহর থেকে মাত্র মাইল দেড়েক দূরে দুই তালা ফতেহপুরে পাক-সৈন্যদের প্রতিরোধ দেবার জন্য তৈরী হয়ে অপেক্ষা করতে লাগল। তাদের সঙ্গে ছিল তিনটা মেশিনগান। এই তিনটা মেশিনগানের মধ্যে একটা ছিল আবদুর রউফ আর তাঁর দুইজন সাথীর হাতে। ই, পি, আর বাহিনির ৮/১০ জন যোদ্ধা বাকী দুইটি পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন। এদের সাহায্য করবার জন্য পঞ্চাশেক ছাত্রও সঙ্গে ছিল। এই প্রতিরোধের দলটি দুইতালার যেখানে ঘাঁটি করেছিল, সেখানে অপেক্ষা করতে লাগল।

 আবদুর রউফ বলেছিলেন: ১১ই এপ্রিল পর্যন্ত শত্রুপক্ষের কারও সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। ১২ই এপ্রিল তারিখে বেলা ১টার সময় আমরা যখন খেতে বসেছি, এমন সময় লক্ষ্য করলাম শহরের দিক থেকে একটা কাল রং এর জীপ আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। একটু দূরে থেকতেই জীপটা থেমে গেল। মনে হলো, জীপের আরোহীরা আমাদের দেখতে পেয়েছে, তাই ওখানে থেমে গিয়েছে। আমরা দেখা মাত্রই খাওয়া ছেড়ে লাফিয়ে উঠলাম। সাথে সাথে আমাদের তিনটা মেশিনগান একই সঙ্গে গর্জন করে উঠল। কিন্তু ওরা আগে থেকেই হুঁশিয়ার হয়ে জীপটাকে একটা গাছের আড়ালে নিয়ে দাঁড় করিয়েছিল। তাই আমাদের গুলি ওদের স্পর্শ করতে পারল না। জীপটা ঐভাবেই কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল। বোধ হয় আমাদের অবস্থানটা পর্যক্ষেণ করে নিচিছল। তারপর গাড়িটা যেদিকে থেকে এসেছিল, সেই দিকে দ্রুতবেগে ছুটে চলে গেল।

 জীপটা চলে যাবার মিনটি কয়েক বাদেই ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে কামানের গোলাবর্ষণ শুরু হলো। গোলাগুলি আমাদের সামনে এসে পড়েছিল। আমরা উপযুক্ত জায়গা খুঁজে নিয়ে আত্মরক্ষার জন্য আশ্রয় নিলাম। ঘণ্টাখানেক ধরে এইভাবে গোলাবর্ষণ চলল। ওরা মনে করল, এই গোলাবর্ষণের পরে পথ নিশ্চয়ই পরিষ্কার হয়ে গেছে, তাদের প্রতিরোদ করবার মত কেউ নেই। তাই ওদের একটা পদাতিক দল নিশ্চিন্ত মনে যশোর নড়াইল সড়ক দিয়ে আসতে লাগল। আমরা ধৈর্য্য ধরে অপেক্ষা করেছিলাম, আসুক, ওরা আরও কাছে এগিয়ে আসুক, তারপর ওদের একবার দেখে নেওয়া যাবে। উপযুক্ত সময় আসতেই আমরা মুহুর্তের মধ্যেই পজিশন নিয়ে দাঁড়িয়ে মেশিনগান চালাতে শুরু করলাম। ওরা এ জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিল না, তাই আমাদের তিনটা