পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৮৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৫৯

 এরপর যাই পিরোজপুর। পিরোজপুরে লেঃ জিয়ার সঙ্গে আমার দেখা হয়। মেজর জলিল তাকে পিরোজপুরের ভার দিয়ে আমাকে নিয়ে বাগেরহাটে যান। বাগেরহাটের অবস্থান শক্তিশালী করে তুলি এবং পরিকল্পনা নিই খুলনা বেতার কেন্দ্র দখল করে নেয়ার জন্য। পরিকল্পনা মোতাবেক ৩/৪ এপ্রিল রাতে বেতার কেন্দ্রে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর আক্রমণ চালাই এবং ২৪ ঘণ্টার জন্য খুলনা বেতার কেন্দ্র মুক্ত রাখতে সক্ষম হই। কিন্তু পাকসেনাদের প্রবল চাপে খুলনা বেতার কেন্দ্র বেশীক্ষণ নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারিনি। খুলনা বেতার কেন্দ্রের যুদ্ধে আমাদের তিনজন শহীদ হন। পাকসেনাদের ৩৫ জনের মত হতাহত হয়। আমরা বাগেরহাটে ফিরে আসলাম।

 বাগেরহাটে এসে প্রথতে খুলনার এম-সি-এ জনাব রহমান, ছাত্রনেতা টুকু এবং অন্যান্যদের সাথে যোগাযোগ করা হয়। যোগাযোগ করে আমরা রূপসা নদী পার হয়ে রাতের আঁধারে খুলনা শহরের পিছন দিক দিয়ে গিয়ে গোল্লামারীতে অবস্থিত খুলনা বেতার কেন্দ্রের নিকটে কলাবাগানে ২টি প্লাটুনকে অবস্থান নিতে বলি। খুলনা থেকে গোল্লামারী আসার পথে একটি ব্রিজ ছিল। সেই ব্রিজের নিচে এ্যামবুশ নেয়ার জন্য আর একটি ছোট গ্রুপকে নিযুক্ত করি। বয়রাতে কিছু ইপিআর ছিল। তাদের বলা হয় আমরা যখন গোল্লামারী বেতার কেন্দ্রে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ব তখন তারা যেন সার্কিট হাউসে অবস্থানরত পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। এদিকে খুলনা শহরের নিকটস্থ গ্রামের দেশপ্রেমিক যুবকদের (নক্সালদের) সাথে যোগাযোগ করা হয়। তারা আমাদের আক্রমণে সাহায্য করার জন্য একসাথে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়বে এই পরিকল্পনা নেয়া হয়। আমাদের পরিকল্পনা ছিল একসাতে পাকসেনাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে খুলনা শহর শত্রুমুক্ত করব।

 পরিকল্পনামত ৩/৪ এপ্রিলের রাত ৯টার সময় গোল্লামারীতে অবস্থিত বেতার কেন্দ্রে শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ি। গোল্লামারীতে অবস্থিত পাকসেনাদের সাহায্য করার জন্য সার্কিট হাউস থেকে আরও সৈন্য ১টা জীপ ও ২টা ডজে করে গোল্লামারীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকে। আগে থেকেই গোল্লামারী-খুলনার মধ্যে আবস্থানরত এ্যামবুশ পার্টি পাকনেসাদের গাড়ীর উপর গ্রেনেড, হাতবোমা নিক্ষেপ করতে থাকে। জীপ এবং ডজ দুটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাক-সেনারা টিকতে না পেরে ব্রীজ এবং বেতার কেন্দ্র ছেড়ে শহরে পালিয়ে যায়।

 বয়রাতে অবস্থানরত ইপিআররা শত্রুদের উপর কোন কারণে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারেনি। সেজন্য আমরা খুলনা শহর দখল করতে পারিনি। বেতার কেন্দ্র চালু করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হই। এ আক্রমণে শত্রুদের ৭৯ জন হতাহত হয়। এদের মধ্যে একজন মেজর ছিলেন। আমাদের পক্ষে তিনজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। হাবিব নামে জনৈক তরুণ ছাত্র ছিল, সে আক্রমণের পূর্বে তার পিতার রিভলবার চুরি করে এই আক্রমণে অংশগ্রহণ করে। তার বয়স কম দেখে আমি তাকে আক্রমণে অংশগ্রহন করতে নিষেধ করেছিলাম। কিন্তু সে আমার চোখে ফাঁকি দিয়ে আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যুদ্ধের পরে তাকে মৃত অবস্থায় দেখি। শহীদদের মধ্যে জনৈক অবসরপ্রাপ্ত ই-এম-ই”র সৈনিকও ছিলেন।

 পরদিন শত্রুরা খুলনা শহর থেকে মর্টারের প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করতে থাকে এবং ৩০-এম-এম-জি থেকে আমাদের উপর মুষলধারে গুলি চালাতে থাকে। আমরা চিন্তা করে দেখলাম শত্রুদের বিরাট শক্তির সাথে পেরে ওঠা সম্ভব হবে না। সেজন্য কৌশলগত কারণে ৫ই এপ্রিল রাতে শত্রুসৈন্যের প্রচণ্ড চাপের মুখে টিকতে না পেরে ফিরে বাগেরহাটে চলে আসি। আমাদের আক্রমণের মূল লক্ষ্য ছিল জনগণকে আমাদের কার্যকলাপ সম্বন্ধে জ্ঞাত করা এবং শত্রুকে পর্যুদস্ত করা। সেটা আমরা করতে পেরেছিলাম।

 বাগেরহাটের তৎকালীন এস-ডি-ও পরিস্থিতির জন্য ভীত ছিলেন। তিনি আমাদের ঠিকমত সাহায্য দিতে পারছিলেন না। বাগেরহাট শহরে অবস্থান নিয়ে থাকা ঠিক হবে না, কেননা শত্রুরা আমাদের অবস্থানের কথা জেনে ফেলেছিল। তাই বাগেরহাটের ছেলেরা বলে খান জাহান আলী সাহেবের দরগার পাশে অবস্থান নিলে ভাল হবে। তাদের একটা বিশ্বাস ছিল দরগার কাছাকাছি অবস্থান নিলে শত্রুরা আক্রমণ করতে পারবে না। সেজন্য