পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৩৯৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭০

 চারজন পাক-সৈন্যকে এভাবে খতম করতে পারার ফলে পূর্ব-নবগ্রাম ও নিকবর্তী গ্রামগুলিতে উৎসাহ ও আনন্দের ঢেউ বয়ে গিয়েছিল। কিন্তু তা একটুকু সময়ের জন্যই; পরমুহূর্তেই সকলের মনে পড়ল যে সামরিক কর্তৃপক্ষ ব্যাপারটাকে কিছুতেই এত সহজে হজম করে নেবে না। মাত্র দেড় মাইল দূরে ওদের ঘাঁটি, ওরা এক্ষণি সদলবলে এসে হানা দেবে এবং কঠিন হাতে এ প্রতিশোধ নেবে। ওদের প্রতিহিংসার আগুনে পূর্ব-নবগ্রাম আর নবগ্রাম এই দু'টি গ্রাম পুড়ে ছাই হবে যাবে। এরপর এখানে একটি জনপ্রাণীকেও ওরা বেঁচে থাকতে দেবে না। এ অবস্থায় প্রাণে বাঁচতে হলে এক্ষুণি, এই মুহুর্তে কোন নিরাপদ জায়গায় চলে যেতে হবে। একটি জায়গা আছে বটে, সেটা হচ্ছে এখানকার বিল অঞ্চল। সেই বিস্তীর্ণ জলরাশির মধ্যে ডাঙা থেকে বহুদূরে বিক্ষিপ্তভাবেই ছড়িয়ে আছে বিল এলাকার ছোট ছোট গ্রামগুলি। সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিলে ঝড়ের এই প্রথম ঝাপটাটা হয়তো সামলে নেওয়া যাবে। পাকিস্তানী সৈন্যরা টের পেলেও ওখানে যেতে সাহস করবে না। বেশী চিন্তা করবার সময় নেই, যা করবার এই মুহূর্তেই করতে হবে। দেখতে দেখতে সমস্ত এলাকা জনমানবশূন্য হয়ে গেল।

 ওরা যা ভেবেছিল তাই ঘটল, খবর পাবার সঙ্গে সঙ্গেই হিংস্র পাক-সৈন্যরা শস্যে ক্ষেতে পঙ্গপালের মত এসে ছেয়ে ফেলল, গ্রামের পর গ্রামে হানা দিয়ে চলল। পাশাপাশি ক'টা গ্রাম ওরা একেবারে উচ্ছন্ন করে দিল।

 এত বড় ঘা খেয়েও মুক্তিফ্রণ্টের লোকদের মনোবল কিন্তু ভাঙেনি। একটা জিনিসের দিকে তাদের বিশেষ লক্ষ্য ছিল, যে চারজন পাকিস্তানী সৈন্য এখানে নিহত হয়েছে তাদের প্রত্যেকের সঙ্গে রাইফেল ছিল। সেই চারটা রাইফেলের মধ্যে একটি ছিল চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেল। এই অস্ত্রটি দুর্লভ। এই অস্ত্রটিকে হাত করতে পারলে শুধু সেটা দিয়েই বহু কাজ হাসিল করতে পারা যাবে। আপাতত তাদের হাতে রাইফেল বা বন্দুক জাতীয় একটিও অস্ত্র নেই। ওই চারটি রাইফেল এই গ্রামেই আছে, ওইগুলিকে বের করে হস্তগত করতে পারলে মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধাদের হাতে-খড়ির কাজ শুরু হতে পারবে।

 সবাই যখন জান-প্রাণ নিয়ে পালাতে ব্যস্ত, মুক্তিবাহিনীর সেক্রেটারি তখন সেই রাইফেলগুলির সন্ধানে উঠে-পড়ে লেগে গেলেন। হাতে সময় নেই, শত্রু সৈন্যরা যেকোন সময় এসে পড়তে পারে, তার আগেই এই অস্ত্রগুলিকে খুঁজে বের করতে হবে। অস্ত্রগুলির সম্পর্কে প্রথমে কেউ কোন কথা বলতে চায় না। বহু মিনতি আর রাগারাগির পর অবশেষে একটি একটি করে সব কটির সন্ধান পাওয়া গেল। সবচেয়ে আনন্দের কথা, সেই চীনা স্বয়ংক্রিয় রাইফেলটিকেও পাওয়া গেছে। মুক্তিপ্রণ্টের সেক্রেটারি উত্তেজনা আর উল্লাসে অধীর। আর চিন্তা নেই, এবার এই ক'টিকে পুঁজি করেই তারা কাজ শুরু করে দেবেন।

 আরও আনন্দের কথা এই যে, রাইফেলগুলির সাথে এক পেটিভর্তি বুলেটও পাওয়া গেছে, যার অভাবে রইফেলগুলি অচল হয়ে থাকত। অস্ত্রগুলি যাদের হাতে এল, তাদের কিন্তু রাইফেল চালনা সম্পর্কে কোন ধারণাই নেই। কারও কাছ থেকে এ বিষয়ে সাহায্য নেবো, এমন লোকও হাতের কাছ নেই। কিন্তু তাতেও তারা ঘাবড়াল না। তাদের উৎসাহ অদম্য। সারারাত জেগে রইফেলগুলিকে নিয়ে নানাভাবে নাড়াচাড়া করতে করতে রাইফেল থেকে গুলি ছুড়বার কৌশলটা বেরিয়ে এল। এ তাদের কাছে এক মহা-আবিস্কার।

 সাফল্যের পর সাফল্য। ভাগ্যলক্ষ্মী তাদের উপর সুপ্রসন্ন হয়ে তাঁর ভাণ্ডারের বন্ধ দরজাটা এবার তাদের সামনে খুলে ধরেছেন। ইতিপূর্বে মার্চ মাসে গৌরনদী থানা এলাকায় যে মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল তাদের হাতে বেশকিছু রাইফেল আর বন্দুক ছিল। সেই মুক্তিবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ার পর মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে অধিকাংশ কে কোথায় চলে গেছে তার কোন পাত্তা নেই। তাদের মধ্যে অনেকেই হয়তো বর্ডারের ওপারে নিরাপদ আশ্রয়ে আছে। কিন্তু তাদের অস্ত্রগুলিকে কোথায় রেখে গেছে তারা? শোনা যায়, এই অঞ্চলেই কোথায় নাকি লুকিয়ে রেখে গিয়েছিল। নবগঠিত মুক্তিফ্রণ্ট তার জন্মের পর থেকেই এই নিরুদ্দেশ অস্ত্রগুলির অনুসন্ধান করে চলেছিল। অবশেষে সেই পুরানো দলের একটি ছেলের সাহায্য নিয়ে সেই মহামূল্য গুপ্ত সম্পদগুলিকে আবিষ্কার করা গেল। সহজ ব্যাপার নয়, রাইফেল আর বন্দুকে মিলিয়ে সতেরখানা। নিহত পাকসৈন্যদের কাছ থেকে পাওয়া চারটি