পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪০০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৭৫

এদের হাতে নিহত হয়েছে। এরা নিজ হাতে অস্ত্র তৈয়ারও করত। আজও সরিকলবাসী আলমের কথা ভোলেনি। নিজের তৈরি বোমার আঘাতেই আলম শহীদ হয়েছেন সরিকলের শামসু মিয়ার বাড়িতে। জনতার প্রতিরোধ শক্তিশালী, দূর্জয়। তার প্রমাণ গৌরনদীর বাকহি। বাকাইর বীর জনতা বল্লম দিয়ে মেরেছিল চার- চারটে তরতাজা পাঞ্জাবী দস্যুকে। কেড়ে নিয়েছিল চারটে চায়না রাইফেল।

 সেদিন ছিল ১৪ই মে। একদল খানসেনা বাকাই গ্রামে ঢুকে পড়েছে। যেভাবে হোক তাদের রূখতেই হবে। তাই প্রস্তুত হয়ে গেল গ্রামবাসী। হাতে বল্লম ও রামদা। কয়েকজন গ্রামবাসী যেখান দিয়ে খানসেনারা আসবে সেই পথের ধারে একটি গর্তের মধ্যে আত্মগোপন করে রইল। কিছুক্ষনের মধ্যেই খানসেনারা কাছে এসে গেল। মুহূর্তের মধ্যে কয়েকটি বল্লম নির্ভুল লক্ষ্যভেদ করলো। বল্লম একেবারে হানাদার চারটের বক্ষভেদ করে দিল। তারপর টুকরো টুকরো করে চড়িয়ে দিল সে মৃতদেহ চারটি। খানসেনারা ওর পর থেকে আর ঢোকেনি বাকাই গ্রামে।

খুলনার প্রতিরোধ যুদ্ধ[১]

খুলনার মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্ব

 ২৫শে মার্চ। পরিস্থিতি গুরুতর, সেটা সবাই বুঝতে পারছে। আবহাওয়া ক্রমেই যেন ভারী হয়ে আসছে। খুলনার রাজনৈতিক নেতারা অবস্থাটা বুঝবার জন্য ঢাকার সঙ্গে টেলিফোনে যোগাযোগ করছিলেন। কিন্তু রাত্রি আটটার সময় ফোনের যোগাযোগ একবারেই বন্ধ হয়ে গেল। তখনি তাঁদের মনে সন্দেহ জাগল ঢাকার অবস্থা ভাল নয়, একটা কিছু অঘটন ঘটতে চলেছে।

 কর্মীদের চোখে ঘুম নেই। রাত্রি ১২টার সময় একটা ঘোষণার শব্দ শুনে তারা মকে উঠল। শুধু তারাই নয়, যারা শহরের ঘুমন্ত মানুষ শয্যা ছেড়ে উঠে বসেছে। সরকারী ঘোষণাকারীরা সারা শহরে ঘুরে ঘুরে মাইকযোগে প্রচার করে ফিরছে যে, আগামীকাল ২৬শে মার্চ সকাল পাঁচটা থেকে সারা শহরে ৭২ (বাহাত্তর) ঘণ্টা পর্যন্ত কারফিউ জারী করা হচ্ছে। এই সময়ের মধ্যে যদি কেউ ঘর ছেড়ে পথে বেরোয় তবে তাকে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করা হবে।

 অনেকেই অনুমান করল, ঢাকা শহরে অথবা আর কোথাও অবশ্যই একটা কিছু হয়ে গেছে এবং তার জের সারা প্রদেশময় ছড়িয়ে পড়বে। কিন্তু প্রথম আক্রমণ করেছে কারা পাস্তিানির জঙ্গী বাহিনী না মুক্তিকামী জনগণ?

 ইতিমধ্যে সবার অগোচরে আরও একটা গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে গেছে। সেটা ঘটেছে কারফিউ জারী করার বেশ কিছু আগেই। এটা একটা আশাতীত সুখবর। আজই রাত্রিতে ইপিআর বাহিনীর জনৈক পাঞ্জাবী অফিসার তাঁর কয়েকটি প্রিয়-পাত্রকে এই বলে হুঁশিয়রী দিয়েছিলেন ইপিআর এর লোকদের সামনে এক ভীষণ বিপদ ঘনিয়ে এসেছে, যদি প্রাণে বাঁচতে চাও আর দেরী না করে এখনি পালিয়ে যাও। স্থানীয় ইপিআর বাহিনীতে প্রায় তিন শত জন লোক। খবরটা তারেদ মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ল। দেখতে দেখতে ইপিআর লাইন খালি হয়ে গেল। তারা রাতের অন্ধকারে সেই স্থান ত্যাগ করে সুশৃঙ্খলভাবে দূরবর্তী গ্রামাঞ্চলে আশ্রয় নিল। আপর দিকে কারফিউ জারী হবার পর অবস্থা সঙ্গীন বুঝতে পেরে শহরের পুলিশরাও তাদের ব্যারাক ছেড়ে পালিয়েছে।

 গভীর উত্তেজনার মধ্য দিয়ে সেই রাতটা কেটে গেল। পরদিন সকালে কি ঘটনা ঘটে দেখবার জন্য সবাই উদ্বিগ্ন কারো চোখে ঘুম নেই। স্বধীনতার সংগ্রাম কি তবে সত্য সত্যই শুরু হয়ে গেছে? বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীরা পরস্পর থেকে বিচ্ছিন্ন। কে কোথায় আছে তাও ভালভাবে জানে না, অথচ অবিলম্বে উদ্যোগ নিয়ে কিছু একটা করতে হবে। সাধারণ মানুষ তো তাদের মুখের দিকেই তাকিয়ে আছে। কারফিউ শুরু হবে কাল


  1. প্রতিরোধ সংগ্রামে বাংলাদেশ থেকে সংকলিত