পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৩৮২

মার্চ সকাল বেলায়ই পেয়ে গেলাম। এ খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ফরিদপুরের পুলিশ ব্যারাক এবং বিভিন্ন থানা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে ফদিপুরের প্রাথমিক প্রবেশদ্বার গোয়ালন্দ ঘাটে ছাত্র-জনতা, পুলিশ ও আনসার সমন্বয়ে প্রতিরক্ষা ব্যূহ গড়ে উঠল এবং ঢাকা-ফেরত কিছু ইপিআর এসে এতে যোগদান করলেন। সর্বস্তরের জনগণের সমর্থনে আমরা উৎসাহিত বোধ করলাম। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত পাক-বাহিনীর বিরুদ্ধে গোয়ালন্দঘাটে ছাত্রজনতার এই প্রতিরোধ শুধুমাত্র রাইফেল, বন্দুক এবং মনোবলকে সম্বল করে একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করা হয়। আশ্চর্য হলেও সত্য এবং আজও ভাবতে অবাক লাগে যে এটা হল সুসজ্জিত পাক-হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মানুষখেকো বাঘের সামনে অবোধ বালকের নুড়ি হাতে খেলা করার মত। এ সকল আয়োজনের ভিত্তি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত জনতার দেশপ্রেম ও মুক্তির আকাঙ্ক্ষা। ফরিদপুরের প্রত্যন্ত এলাকায় এভাবে জনতার প্রতিরোধের সাড়া পড়ে গেল। তখন প্রয়োজন দেখা দিল সুসমন্বয় ও প্রশাসনিক নির্দেশ প্রদানের। খুব সম্ভব ২৯শে মার্চ তদানীন্তন নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য কে, এম, ওবায়দুর রহমানকে আহবায়ক করে এডভোকেট আদেলউদ্দিন, ইমামউদ্দিন আহমেদ, শামছুদ্দিন মোল্লা, সৈয়দ হায়দার হোসেন, মোশাররফ হোসেন, নূরুন্নবী, কাজী খলিলুর রহমান, মুজিবুর রহমান খান, গৌরচন্দ্র বালা, ফিরোজার রহমান, আমিনউদ্দিন, মোখলেসুর রহমান প্রমুখ স্থানীয় জননেতা ও কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নাসিরুদ্দিন মুসা, শাহ আবু জাফর, কবিরুল আলম, সালাউদ্দিন আহমদ, আবু সাঈদ, আতিয়ার প্রমুখ ছাত্র ও জনপ্রতিনিধিমূলক নেতা ও কর্মীদের নিয়ে জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। এই কমিটি সার্বিকভাবে ফরিদপুরের প্রশাসন ও তদারকি কাজ পরিচালনা করতে থাকে। ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক ছিলেন তখন এ, এন, এম ইউসুফ এবং পুলিশ সুপার ছিলেন নূরুল মোমেন খান। পরবর্তীকালে ফরিদপুরে পাক-হানাদার বাহিনী প্রবেশের পরেই তাঁরা ধৃত হন এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে দীর্ঘ প্রায় নয় মাস কারাবাসের পর মুক্তি লাভ করেন। ফরিদপুরের সর্বস্তরের নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র, ব্যবসায়ী এবং সাংবাদিকের মধ্যে বিশেষ করে লিয়াকত আলী হোসেন, আব্দুস সালাম মিয়া, আজম আমীর আলী, আনম আবদুস সোবহান, মিছির কর্মকার, আতাহার হোসেন, শামসুল হক, তারাপদ ঘোষ এবং অনেকের কথা স্মরণ করা যায়। এছাড়াও ফরিদপুরের গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুরের প্রত্যেক মহকুমায় স্থানীয় প্রতিরোধ কমিটি গঠন করা হয়। রাজবাড়িতে মরহুম কাজী হেদায়েত হোসেন, মোসলেম আলী মৃধাসহ জননেতা ডা. এস, এ, মালেক, ওয়াজেদ চৌধুরী, নূরুল ইসলাম, মরহুম আবদুল জলিল, আবদুল হাই, চিত্তবাবু, আলী আক্কাস এবং স্থানীয় ছাত্রনেতা আবদুল জব্বার, নাজিবর, ফজলু, রেজা, তাপস প্রমুখ।

 ফরিদপুর জেলা সমন্বয় ও প্রতিরোধ কমিটির মূল ক্যাম্প স্থাপন করা হয় ডিস্ট্রিক্ট কাউন্সিলের ডাক বাংলো ঝিলটুলীতে এবং সেখান থেকে প্রত্যেকটি মহকুমায় যোগাযোগ রক্ষা করার ব্যবস্থা করা হয়। হানাদার বাহিনী ফরিদপুরে প্রবেশ করার আগে পর্যন্ত এ দিনগুলো ছিল ফরিদপুরের ইতিহাসে একটি অবিস্মরণীয় সময়কাল। ফরিদপুরের প্রতিরোধের সেই সাতাশটি দিন মনে হোত আমরা সম্পূর্ণ একটি স্বাধীন জনগণতান্ত্রিক ভূখণ্ডে বাস করছি। কোথাও কোন স্বাভাবিক আইন-শৃঙ্খলার অবনতি পরিলক্ষিত হয়নি। এ যেন জনতার স্বতঃস্ফূর্ত নতুন জীবনের পথে স্বাভবিক পথ চলা। ঢাকা থেকে বহু প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট পাক-হানাদার বাহিনীর অনেক কুর্কীতি শুনতে পেলাম এবং ফরিদপুরে আমরা আতংকিত হলাম। সম্ভবতঃ ১লা এপ্রিল তারিখে প্রয়াত নেতা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ দিল্লীর পথে ফরিদপুর পৌঁছালেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশ প্রদান করে পরের দিন চলে গেলেন। ১৭ই এপ্রিল বাংলার মাটিতে মেহেরপুরে মুজিবনগরে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঐতিহাসিক ঘোষণার কথা জানতে পারলাম এবং ফরিদপুরকেও আমরা তখন মুক্ত এলাকার একটা অংশ হিসেবে গর্ব অনুভব করলাম। আমরা তখন ফরিদপুরে স্থানীয় প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করতাম। সে সময় ফরিদপুরবাসীদের সার্বিক সুখ-দুঃখ এক উচ্ছ্বাসময় শিহরণের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছিল। কখন হানাদার বাহিনী ঢুকে পড়ে সেটাই ছিল সার্বক্ষণিক চিন্তা। দেশের অন্যান্য জায়গায় পাক-বাহিনীর নারকীয় অমানবিক দস্যুতার খবর চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। আমাদের বেশী ভয় ছিল প্যারাট্রুপ হানাদার বাহিনী নামলে