পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
১৬

এগারোটার সময় ঢাকা পিলখানা ইপিআর হেড কোয়ার্টার থেকে টেলিফোনে পাক হানাদার কর্তৃক রাজারবাগ পুলিশ রিজার্ভ ও ইপিআর হেড কোয়ার্টার আক্রমণের সংবাদ পাই। টেলিফোনে ইপিআর হেড কোয়ার্টার থেকে আমাদেরকে সশস্ত্রভাবে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরী থাকতে বলা হয়। আমরা আমাদের ১৪নং ব্যারাকে মোট পঞ্চাশজন সিপাহী এএসআই, হাবিলদার ও সাধারণ সিপাহী উপস্থিত ছিলাম। এ সংবাদ দ্রুত রাজারবাগ রিজার্ভ পুলিশের আরআই ও এসপি হেডকোয়ার্টারকে জানানো হয়। এ সংবাদ পেয়ে রিজার্ভ পুলিশের সকল অফিসার ও উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাই ডিউটিতে এসে সকল সিপাহী, সুবেদার, এএসআই, এসআই, হাবিলদার সবাইকে অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত করে পাক হানাদারদের মোকাবেলা করার জন্য তৈরী করেন এবং প্রত্যেককে ডিউটিতে মোতায়েন করেন। তৎকালীন রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশ সুপার মিঃ শাহজাহান ও আরআই মিঃ মফিজউদ্দিন আমাদের এই সশস্ত্র প্রস্তুতিতে নেতৃত্ব দান করেন।

 পুলিশ সুপার ও আরআই উভয়েই শেষ রক্তবিন্দু পর্যন্ত পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়ে যাওয়ার জন্য জ্বালাময়ী ভাষায় সংক্ষিপ্ত নির্দেশ দান করে নিজ নিজ দায়িত্বে চলে যান। এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সমস্ত বাতি নিভিয়ে দেয়া হয়। আমরা সকল সিপাহী, হাবিলদার, সুবেদার, এএসআই, এসআই সবাই সশস্ত্রভাবে পজিশন নিয়ে হানাদার পাক বাহিনীর অপেক্ষা করতে থাকি। এসময় অয়ারলেস এবং টেলিফোন সব কিছু অচল করে দেয়া হয়েছিল। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বাইরে সহস্র ছাত্র-জনতা বড় বড় গাছ, লইটপোস্ট, ইট- পাটকেল ফেলে ব্যারিকেড তৈরী করে। রাজারবাগে প্রবেশ করার পথে পথে বহু প্রশস্ত ড্রেন কাটা হয় হানাদার বাহিনীর অগ্রগতি প্রতিরোধ করার জন্য। এভাবে প্রস্তুতি ও প্রতিরোধ তৈরী করার মধ্য দিয়ে সাড়ে এগারোটা বেজে যায়। পাক হানাদাররা রাত সাড়ে এগারটার সময় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে চারিদিক থেকে লাইট বোম মারতে মারতে অগ্রসর হয়। এর মধ্যে চলছিল বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ, কামান ও ট্যাংকের গর্জন। পাক হানাদারদের হামলার সাথে সাথে আমরা সবাই আমাদের সামান্য রাইফেল বন্দুক নিয়ে ওদের হামালার প্রাণপণ জবাব দিতে থাকি। ওরা আমাদের দৃঢ় মনোবল দেখে এরপর যুগপৎ কামান ও ট্যাংক ব্যবহার করে। আমরা টিকতে না পেরে ক্রমে পিছু হটতে থাকি। আমাদের আধিকাংশ বীর যোদ্ধা লড়তে লড়তে শহীদ হন। অনেকে দারুণভাবে আহত হয়ে মৃতবৎ সেখানেই পড়ে থাকেন। আর অনেকে আহত দেহ নিয়ে প্রাণরক্ষা করতে সমর্থ হন। পাক হানাদার পশুরা আমাদের লৌহকঠিন মনোবল ভেঙ্গে দেয়ার জন্য এরপর রাজারবাগ পুলিশ লাইনের সকল ব্যারাকে লাইট বোমা ও প্রেট্রোল দ্বারা আগুন লাগিয়ে দেয়। আমাদের বহু আহত যোদ্ধা ঐ সকল ব্যারাকে আটকা পড়ে জ্বলন্ত আগুনে দগ্ধীভূত হয়ে শাহাদাৎ বরণ করেন। আনুমানিক রাত তিনটার সময় অবিরাম গোলাবর্ষণের মধ্য দিয়ে আমি আমার অস্ত্র ফেলে দিয়ে আত্মরক্ষা করার জন্য ঢাকা শহরের বাইরে চলে যাই।

সাক্ষৎকারঃ শরীফ খান মোহাম্মদ আলী[১]

আর্মড সাব-ইন্সপেক্টর অব পুলিশ

বিআরপি, রাজশাহী

৩-২৭৪

 ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ সকাল থেকে আমাদের পুলিশ লাইনে নীরব, নিস্তব্ধ ও থমথমে ভাব বিরাজ করছিলো। স্পেশাল আর্ম ফোর্স-এ আমার লাইনে রাত আটটার বাইরের কর্তব্যরত সিপাহী বাদে আমি নাম ডাকার সময় মাত্র ত্রিশজন বাঙ্গালী সিপাহীকে উপস্থিত পেয়েছি। আমি কোন অবাঙ্গালী সিপাহীকেই লাইনে উপস্থিত পাইনি। ওরা সন্ধ্যার পরপরই আমার লাইন থেকে ডিউটি ত্যাগ করে কোথায় উধাও হয়ে গিয়েছিল তার কোনো হদিস পাইনি। নাম ডাকার সময় বিপুলসংখ্যক সিপাহীর এভাবে উধাও হয়ে যাওয়ার ঘটনা রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ইতিহাসে আর ঘটেনি। ঢাকা জেলা রিজার্ভ লাইনের এ অবস্থা ছাড়া কেন্দ্রীয় লাইন থেকেও


  1. ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইনে হাবিলার মেজর হিসেবে কর্মরত ছিল।