পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৪৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৪৫৪

দেয়ার চেষ্টা করেননি বরং আমার কাছ থেকে নেতৃত্ব আদায়ের চেষ্টা করেছে। তাদের জোরেই আমি নেতা হয়েছিলাম।

 কাদের সিদ্দিকী বলেন, কাদের বাহিনী নাম আমি দিইনি। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকেই প্রথম আমাদের যুদ্ধকে কাদেরিয়া মার বলে বর্ণনা করে। আমার বাহিনীর নাম দেয় কাদের বাহিনী। পরে আমার ছেলেরাও এই নাম গ্রহন করে। বঙ্গবন্ধুও পাকিস্তানি কারাগার থেকে বেরিয়ে এসে আমাদেরকে কাদের বাহিনী নামে অভিহিত করেন। কিন্তু আমি আগেও ভাবতাম এবং আজো ভাবি স্বাধীনতার জন্যে আমরা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আমরা মুক্তিবাহিনী। মুক্তিযোদ্ধা।

 ৩রা জুন কাদের বাহিনীর সাথে সংঘর্ষ হয় গোপালপুর, মধুপুর ও টাঙ্গাইল থানার সম্মিলিত পুলিশ বাহিনীর সাথে। খণ্ডযুদ্ধ হয় বইলামপুরে। হেরে পুলিশ বাহিনী পালিয়ে যায়। সাতজন পুলিশ কাদের বাহিনীর হতে গ্রেফতার হয়। ১২ই জুন হলো বল্লার যুদ্ধ। পাঁচ ঘণ্টা চলে এই যুদ্ধ। কাদের সিদ্দেকীর ভাষায় জনগণের মনোবল বৃদ্ধির জন্য প্রথম পর্যায়ের এই যুদ্ধ অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে আমাদের কাছে আবির্ভূত হয়েছিল। দল সংগঠনের পর খানসেনাদের সাথে এটা ছিল আমাদের প্রথম সম্মুখযুদ্ধ। আমরা ছিলাম প্রায় ১৫০জন। কিন্তু পজিশন নিয়েছিলাম কৌশলগত কারণে মাত্র ১৩ জন। সেই যুদ্ধে ১৬ জন পাকসেনা নিহত হয়। আহত কত হয়েছিল বলতে পারবো না। যুদ্ধে ওরা হেরে গিয়ে পিছিয়ে গেলো। কিন্তু লাশগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য তারা তখনো গুলি চালিয়ে একটি কভার সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল। আমি তখন ভাবছি, খান সেনাদের অন্তত কয়েকটি লাশ আমাদের নিয়ে যেতেই হবে। তাহলে মানুষ বিশ্বাস করবে যে আমরাও লড়তে পারবো। আপ্রাণ চেষ্টা করে পাঁচটি লাশ নিয়ে এলাম। একটি লাইট মেশিন গানসহ ৯টি রাইফেলও হস্তগত করলাম। কিন্তু সেদিন মেশিনগান রাইফেলের চেয়েও বড় কাজ এসেছিল ওই লাশগুলো। ৫টি লাশ দেখার জন্য কুড়ি হাজারের মতো লোক জমায়েত হয়েছিল। এমন কোন লোক ছিল না যে লাশগুলোকে সেদিন ঘৃণাভরে লাথি মারেনি। পরে লাশগুলোকে আমরা নদীতে ভাসিয়ে দিই। এরপর জনগনের মনে এক অদ্ভুত উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়েছিল।

 আগষ্ট মাসে কাদের সিদ্দিকীর হাতে গুলি লাগে। টাঙ্গাইল থেকে ১২৮ মাইল পথ পাড়ি দিয়ে তিন দিনে তিনি সীমান্তের ওপারে গিয়ে পৌঁছেন। ২৩শে আগষ্ট তিনি চলে যান। বাংলাদেশ আবার ফিরে আসেন ১৩ই সেপ্টেম্বর। ভারত আবস্থানকালীন অভিজ্ঞতা সম্পর্কে কাদের সিদ্দিকী বলেন যে, ভারতীয় বাহিনী আমার সাথে খুব ভাল ব্যবহার করেছে। আমার যদ্দুর জ্ঞানবুদ্ধি আছে তাতে মনে করি ভারতীয় বাহিনীর লোকেরা খুব ভালো করেই অনুভব করেছে যে আমাদের স্বাধীন করা উচিত।'

 কাদের বাহিনীর সংগঠনগত ব্যাপারে কয়েকটি প্রশ্নও আমি কদের সিদ্দিকীর কাছে রেখেছিলাম। তিনি জানান, মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক হিসাবে ছিল স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী। প্রত্যেক ইউনিয়ন, গ্রাম এবং ওয়ার্ডে এই বাহিনী ছিল। মুক্তিযোদ্ধারা জনগনের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখতো না। মুক্তিফৌজ কোথাও অপারেশনে গেলে বা ঘাঁটি গেড়ে অবস্থান করলে তাদের খরবদারির ভার থাকতো স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর হাতে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যেও কয়েকটি দল ছিল। এগুলো হলো হেলথ কোর, যোগাযোগ দল ও যুদ্ধের দায়িত্বপ্রাপ্ত যোদ্ধাদল। এই শেষোক্ত শ্রেণীই ছিল সর্বাধিক সম্মানের অধিকারী। যোদ্ধাদের প্রশিক্ষণের জন্য কোন ক্ষেত্রের অভাব ছিল না। যুদ্ধক্ষেত্রেই তারা প্রশিক্ষণ পেয়েছে। বিশেষ কোন ট্রেনিং দিয়ে তাদের যুদ্ধ শেখাতে হয়নি। শত্রুর মোকাবেলা করেই তারা যুদ্ধ শিখেছে। টাঙ্গাইল জেলায় কাদের বাহিনী তাদের তৎপরতা সর্বাধিক কেন্দ্রিভূত করেছিল। পাঁচটি সেক্টরে জেলাটি বিভক্ত ছিল। কোম্পানীর অধিনায়ক হিসেবে কাউকে কখনো বিশেষ দায়িত্ব দেয়া হয়নি। একজন সিনিয়র কোম্পানী কমাণ্ডারের উপর তার নিজস্ব কোম্পানী ছাড়াও সেক্টরের দায়িত্ব দেয়া হতো।