পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৫১৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র: নবম খণ্ড
৪৯১

থাকতো। এই পতাকাকে কেন্দ্র করে পাক হানাদাররা আক্রমণের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়। হেলিকপ্টারে করে কমাণ্ডো নামাতে চেষ্টা করেও পারেনি। পুরো রূপগঞ্জ থানা তখন গেরিলা ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে। শীতলক্ষ্যা পাড় ধরে মিলগুলোতে ছিল আর্মি বাংকার। তারা গেরিলা আক্রমণে আস্তে আস্তে কেটে পড়তে থাকে। ঢাকায় যখন ৩রা ডিসেম্বরে ভারতীয় বিমান এয়ার পোর্টে বম্বিং করে তখন ঢাকার লোক শহর ত্যাগ শুরু করে। এই শহরত্যাগীরা বাসাবো এবং পরে ভাঙ্গা ব্রীজটা পার হয়েই বাংলাদেশের পতাকা আর অস্ত্র নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের দেখে অবাক হয়ে যায়।

 বিমান আক্রমণের রাতে গেরিলার সব পজিশন নিয়েছিল। কারণ, রাতে বিমান আক্রমণে বিভিন্ন অংশ থেকে পাক আর্মি এবং রাজাকাররা রাইফেল ফায়ার শুরু করে প্লেনের উদ্দেশ্যে। গেরিলারা প্রথমভাবে চারিদিক থেকে পুরো অঞ্চলটা ঘেরাও করা হচ্ছে। কিন্তু পর মুহূর্তে আকাশে প্লেন দেখে বুঝে নেয় ব্যাপারটা কি।

 এর ভেতর ঢাকা শহরের উপর 'ক্র্যাক' প্লাটুন বড় কিছু করেনি। কিন্তু যেদিন বেতারে সপ্তম নৌ- বহরের কথা বলো হলো তার পরদিন দু'জন গেরিলাকে পাঠিয়ে দেয়া হল আমেরিকান সেণ্টারে উড়িয়ে দিতে। ঢাকা শহরে হানাদারদের নাকের ডগায় আমেরিকান সেণ্টার উড়িয়ে দেয়া হয়।

 এদিকে গুল টেক্সটাইল মিলের শত্রুবাংকার আক্রমণ করা হয়। বাইরে থেকে শত্রুর রি-ইনফোর্সমেণ্ট ঘটে। পুরো এলাকা নিয়ে যুদ্ধ হয়। শত্রু ২৭টি লাশ রেখে পালিয়ে যায়। গেরিলারা বৃহত্তর আক্রমণ প্রতিরোধের ব্যূহ রচনা করে। এ সময় ঢাকা থেকে দাঙ্গার সম্ভাবনার খবর আসে। কিছু গেরিলা শহরে চলে স্টেনগান নিয়ে দাঙ্গা প্রতিরোধ করার জন্যে। এদিকে শহর থেকে বেরুবার প্রত্যেকটি পথে এ্যামবুশ পেতে রাখা হয়। প্রত্যেকটা মুক্তিবাহিনীর গ্রুপই এসব এ্যামবুশে অংশ নেয়। দু'একটা সিভিলিয়ান গাড়ী করে বিচ্ছিন্নভাবে প্রত্যাবর্তন করতে দেখা যায় শত্রু অফিসারদের। শহরে পালিয়ে আসছিলো তারা। তারাই ফাঁদে পড়ে। পাক হানাদারদের নিশ্চল হয়ে যেতে দেখেই গেরিলারা বুঝেছিল যুদ্ধ করার ক্ষমতা আর তাদের নেই। যুদ্ধ শেষ হল বলে।

 এগারোই ডিসেম্বর খবর আসে ভারতীয় বাহিনী তারাবোর কাছাকাছি এসে গেছে। এর পরই এসে পড়েন ক্যাপ্টেন মালেক ২নং সেক্টরের সেক্টর ট্রুপ নিয়ে। তিনি সিদ্ধান্ত নেন নারায়ণগঞ্জ রোডের পাশে স্লটার হাউজের শত্রব্যূহ তিনি আক্রমণ করবেন। কিন্তু সকালে খবর এলো শীতলক্ষ্যার উপর সেকেণ্ড বেঙ্গল রেজিমেণ্ট প্রতিরক্ষা ব্যূহ রচনা করেছে। সমস্ত মর্টার-এর মুখ এদিকে, গেরিলারা মনে করে বোধ হয় শত্রুর আক্রমণ এদিক থেকেই ঘটবে। শহর আর শীতলক্ষ্যার মধ্যবর্তী অঞ্চলের সব গেরিলা হয় আরো সামনে আসে অথবা লক্ষ্যার ওপারেই চলে যায়। অবস্থা বুঝে সেকেণ্ড বেঙ্গল রেজিমেণ্ট বালু নদী পর্যন্ত অগ্রসর হয়।

 ১৩ ডিসেম্বর তারিখে মেজর হায়দারকে একা একা পৌঁছান, রূপগঞ্জ এলাকায় ‘এস' ফোর্সের অধিনায়ক কর্নেল শফিউল্লাহর সঙ্গে দেখা হয় তার লক্ষ্যার তীরে।

 কর্নেল শফিউল্লাহ মেজর হায়দারকে জিজ্ঞেস করেন, হায়দার তোমার ছেলেরা এখানে এভাবে ঘোরাফেরা করছে কেন?

 মেজর হায়দার বলেন, স্যার এরা ন'মাস ধরে এখানেই আছে। এদের সব চেনা।

 মানুষের সঙ্গে মিশে যুদ্ধ করেছে গেরিলারা। প্রত্যেকটা ঘরে ছিল তাদের ঠাঁই। লোকের বিশ্বাস তাদের আত্মবিশ্বাস দিয়েছে শত্রুকে প্রতিহত করার। গ্রামবাসীরা তাদের ভেতর জাগিয়ে দিয়েছে দায়িত্ববোধ।

 এক সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ আক্রমণ গেরিলারা করতে পারেনি। মেজর হায়দারকে সঙ্গে পেয়েও নতুন আক্রমণের পরিকল্পনা রচনা সময় পায়নি। দরকার হয়নি বলে।