পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (নবম খণ্ড).pdf/৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : নবম খণ্ড
৭১

 ইতিমধ্যে ইপিআর কোম্পানীর গোলাবারুদ প্রায় নিঃশেষ হয়ে আসে। অপরদিকে হালিশহর সদর দফতরেও বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করার মতো গোলাগুলি আর তেমন ছিলো না। এই পরিস্থিতিতে আমি কুমিরার কোম্পানীকে পেছনে সরে শহরের উপকণ্ঠে নতুন প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নিতে বললাম। স্থানটি হালিশহরে আমাদের অবস্থানের নিকটেই ছিলো। আমরা তীব্রভাবে গোলাগুলি এবং নতুন সৈন্যের প্রয়োজনীয়তার অভাব অনুভব করি। অথচ সেই মুহুর্তে এগুলো সংগ্রহ করা দুঃসাধ্য ছিলো। এদিকে রাঙ্গামাটি থেকে আগত ইপিআর সেনারা ক্যাণ্টনমেণ্টের অদূরে বাধাগ্রস্ত হয় এবং রামগড় এলাকার অপর দুটি ইপিআর কোম্পানীও মুল সড়ক পথ ধরে অগ্রসর হতে পারছিলো না। এ সময় আমার সামনে দুটি বিকল্প পথই খোলা ছিলো। হয়, ক্যাণ্টনমেণ্টের অস্ত্রাগার দখল করা অথবা সরবরাহের জন্য ভারতের সাথে যোগাযোগ করা। অন্যসব সম্ভাবনা ব্যার্থ হলে চূড়ান্ত পন্থা হিসাবে শেষেরটিই বিবেচনা করা যায় বলে মনে করলাম। আমি প্রথম পন্থা গ্রহনের সিদ্ধান্ত নেই এবং তখনই রামগড়ের একটি কোম্পানীকে মাঠের পথ ধরে অগ্রসর হয়ে ক্যাণ্টনমেণ্টের পেছনে অবস্থানকারী আমাদের সেনাদের সঙ্গে যোগ দেয়ার নির্দেশ দিলাম। অপর কোম্পানীটিকে শুভপুর সেতু এলাকায় শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ গড়ে তুলতে বললাম যাতে সড়ক পথে কুমিল্লা থেকে নতুন কোনো পাক সৈন্য চট্টগ্রাম আসতে না পারে।

 ২৬শে মার্চ সন্ধা সাড়ে ৮টার দিকে নৌ-বাহিনীর যোগাযোগা ঘাঁটিতে পাক সৈন্যদের আনাগোনা লক্ষ করা গেলো। রেলওয়ে পাহাড়ে আমার ট্যাকটিক্যাল হেড কোয়ার্টার থেকে পাশের একটি মসজিদে তাদের আনাগোনা পরিস্কার দেখা যাচ্ছিলো। কয়েকজন বেসামরিক ব্যাক্তিও তাদের সঙ্গে মসজিদে যোগ দেয়। এই সময়ই হালকা মেশিনগান নিয়ে অবস্থানকারী আমার একজন সিপাই যে মুহুর্তে ট্রেঞ্চ থেকে মাথা তুললো অমনি একটি বুলেট তাকে আঘাত করলো। গুলিটি আসে মসজিদের দিক থেকে। সাথে সাথে শত্রুরা আমাদের অবস্থানের ওপর স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের সাহয্যে ব্যাপকভাবে গুলি চালাতে শুরু করলো। কামানের গোলা আমাদের চতুর্দিকে পড়তে থাকে। বিস্ফোরিত গোলার মারাত্মক টুকরোগুলো ভয়াবহরূপে চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই শত্রুদের একটি দল টাইগার পাস ঘাটি থেকে আক্রমন চালায়। অবশ্য এই আক্রমন সাথে সাথেই প্রতিহত করা হলো। কিছুক্ষণ পর অপরদিক থেকেও হামলা হতে থাকে। তবে দুটি হামলাই সামনের দিক থেকে আসছিলো বলে ওরা তেমন সুবিধা করতে পারেনি। বরং পাকিস্তানিরা প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করে। সামনে অগ্রসর হতে ব্যার্থ হয়ে তারা পিছু হটে গিয়ে তাদের সুদৃঢ় ঘাটি থেকে আমাদের অবস্থানের ওপর অবিরাম গুলি বর্ষণ করতে থাকলো।

 অনুরুপভাবে আমাদের হালিশহর অবস্থানের ওপর কয়েক দফা হামলা হলো। কিন্তু প্রতিবারই শত্রুসেনারা হটতে বাধ্য হলো। ২৬শে এবং ২৭শে মার্চের মধ্যবর্তি রাতকে মনে হচ্ছিলো এ রাত যেন আর পোহাবে না। গুলির শব্দে গোলার বিস্ফোরনে সমস্ত শহর কেঁপে কেঁপে উঠছিল বারং বার।

 এ সময় আমার অবস্থানের পেছনেই ট্যাংকের আওয়াজ পেলাম। অন্য কোনো ভাবে আমাদের অবস্থান দখল করতে না পেরে শত্ররা ক্যাণ্টনমেণ্ট থেকে ট্যাংক নিয়ে অগ্রসর হচ্ছিলো। রেলওয়ে হিলে আমাদের অবস্থান শত্রুদ্বারা ঘেরাও আসন্ন হয়ে উঠলো। অথচ কোনো ট্যাংকবিধ্বংসী অস্ত্র আমাদের ছিলো না।

 প্রায় দু'ঘণ্টা পর কামানের গোলা বর্ষণ একটু কমে এলো। এ সময় আহত সৈনিককে আমার কমাণ্ড পোস্টে নিয়ে আসা হলো। সে ছিলো বয়সে তরুন। কাদামাটি লাগা কাপড়চোপড় রক্তে ভেজা। বুলেট তার বুকে বিদ্ধ হয়েছিলো। দারুন কষ্টে নিঃশ্বাস টানতে গিয়ে আস্ফুট কণ্ঠে সে জিজ্ঞেস করলো “কখন আমার মৃত্যু হবে?” তার দৃষ্টিতে ছিলো সারা বিশ্বের ব্যাকুল জিজ্ঞাসা। এরপর সে আর কিছু বলতে পারে নি। আরো অনেকের মতই নিভৃত যন্ত্রনায় সেও আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেলো।