পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৯৮

মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে আমাদের সাদর অভ্যর্থনা জানান হয়। মেঘালয়ের জনগণের অধিকাংশ খৃষ্টান। তারা ইংরেজী শিক্ষায় শিক্ষিত। মিশনারীদের পুরাতন প্রভাব বিদ্যমান। এখানে পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরার মত সহায়তা এত ব্যাপক নয়। আমাদের লোকদের অবস্থা খুবই শোচনীয়।

 মেঘালয় সরকারের সাথে সরাসরি আলোচনা হলো। হেনা ভাই-এর সাথে মুখ্যমন্ত্রীর ছাত্র জীবনের সম্পর্ক ছিল। আলোচনায় এ সম্পর্ক আরো গভীর হলো।

 এখানেই মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয়। খবর পেয়ে তিনি ডাকবাংলোতে আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। মুক্তিযোদ্ধাদের ভেতর থেকে প্রতিশ্রুতিপূর্ণ অফিসারের একটা গ্রুপ তৈরীর ভার ছিল জিয়ার ওপরে। কয়েকদিন পূর্বে জিয়া সৃষ্ট আমাদের শিক্ষানবিশ গ্রুপটিকে পাক বাহিনী ধ্বংস করে দিয়েছে। এর কারণ অনুসন্ধান করাও আমার দায়িত্বের অন্তর্ভুক্ত ছিল। আমরা ঘটনাস্থলে গেলাম। সেই পরিত্যক্ত ক্যাম্প সার্ভে করি। সব কিছু শুনে মনে হলো শত্রুর মুখে শিক্ষানবিশ অফিসাররা নিতান্তই নিরাপত্তাহীন ছিল। এত বড় আঘাতের রেশ তখনো কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়নি। মেঘালয়ের কাজ শেষে আমরা শিলং-এর পথে রওয়ানা হই। পাহাড়ী পথ বেয়ে আমাদের গাড়ী চলতে থাকে। পাহাড়ী অঞ্চলে রাতের বেলা শীত বাড়ে।

 জঙ্গলে ক্যাম্প স্থাপন করে মুক্তিযোদ্ধারা বিভিন্ন ক্যাম্পে শত্রুহানার পরিকল্পনায় ব্যস্ত। রাতের বেলা এমন একটি ক্যাম্পে গিয়ে আমরা উপস্থিত হই। পরিত্যক্ত বাড়ীতে ক্যাম্প করা হয়েছে। চালা দেয়া ঘর এবং কয়েকটি তাঁবু রয়েছে ছেলেরা তখন আগুন পোহাচ্ছিল। শীতের মধ্যে তাদের প্রয়োজনীয় কাপড় নেই। পাহাড়ী জঙ্গলে খাওয়া দাওয়ার এমনিতেই অসুবিধা। যোগাযোগের অবস্থাও ভাল নয়। এই অবস্থায়ও মুক্তিযোদ্ধাদের মুখে অম্লান হাসি। তাদের সাথে অনেকক্ষণ খোলাখুলি কথা হয়। কারো কারো প্রশ্ন, স্বাধীনতার পর দেশকে কিভাবে পুনর্গঠিত করতে হবে। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য কি ব্যবস্থা নেয়া হবে ইত্যাদি। তাদের প্রয়োজনীয়তার কথা জিজ্ঞাসা করি। তারা জানান, তাদের প্রয়োজন শুধু অস্ত্রের। তাদের অভাবের তালিকায় শীতবস্ত্র, জুতা, কম্বল ও খাওয়াসহ অনেক কিছু ছিল। কিন্তু তারা এ সবের কিছুই উল্লেখ করে নি। তাদের সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ দাবী হলো অস্ত্র চাই। শত্রুকে হত্যা করে দেশকে মুক্ত করতে হবে।

 সারারাত গাড়ী চালিয়ে আমরা পথ অতিক্রম করে পরদিন সিলেট সীমান্তে আসি। পথে পথে বহু শিবির আমরা পরিদর্শন করেছি। সিলেটের কিছু অঞ্চল মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে রয়েছে। হেনা ভাই-এর খুব ইচ্ছা বাংলার মাটিতে রাত কাটাবেন। বর্ষার পানিতে সিলেটের হাওড় তখনো পরিপূর্ণ। আমাদের আসার খবর চারদিকের গ্রামে ছড়িয়ে গেছে। ছোট ছোট নৌকায় আমাদের দলীয় নেতাকর্মীরা দেখা করতে এলেন। নেতৃবৃন্দ ও স্থানীয় বি এস এফ কর্মকর্তার সাথে আলোচনা শেষে শিলং-এর পথে যাত্রা করি।

 এখানে মুক্তাঞ্চলে বহু শরোণার্থী শিবির রয়েছে। রয়েছে মুক্তিযোদ্ধা শিবির। এখান থেকে গিয়ে তারা হানাদারদের ওপর হামলা চালাচ্ছে। স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়ছে। একটি গ্রামে পৌঁছলাম। সেখানে বিরাট জনতার সমাগম হয়। স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ও আমরা বক্তৃতা করি। স্বাধীন বাংলার মাটিতে প্রকাশ্যে জনসভা করতে পেরে অফুরন্ত আনন্দ পেলাম। জনসভা শেষে রাতেই আমাদের শিলং পৌছার কথা রয়েছে। এই অঞ্চলে সিলেটের একজন এম.পি আবদুল হক অত্যন্ত দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। স্বাধীনতার পর তিনি এক সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হন।

 সেখান থেকে আমরা শিলং ডাকবাংলাতেই যাই। সিলেটের একজন এম.পি এই অঞ্চলে প্রধান সমন্বয়কারী ছিলেন। এই এম.পির নাম ব্যারিষ্টার মোনতাকিম চৌধুরী পরে তাকে জাপানে রাষ্ট্রদূত নিয়োগ করা হয়। এখানে স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সাথে কয়েকটি বৈঠক করি। পরদিন আমরা সিলেট ও আসামের সীমান্তে অবস্থিত ‘বালাট’-এর পথে রওয়ানা হই। কিছুদিন পূর্বে বালাটের কাছে পাক বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে আমাদের