পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১২৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১০০

মুক্তিযুদ্ধের সময় বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব সাহস দেখে মন ভরে উঠতো। প্রথম প্রথম বেশ ভয় করতাম। পরে আস্তে আস্তে অভ্যস্ত হয়ে যাই। একদিন ভারতীয় একজন জেনারেলের কথা শুনে আমার ভয় অনেকটা কমে গেল। তিনি বলেন, ‘যে গুলিতে তুমি মারা যাবে, সে গুলির আওয়াজ তোমার কানে আসবে না। আর যে গুলির শব্দ তুমি শুনছ, তা তোমার গায়ে লাগবে না।’ এরপর বলতে গেলে গুলির শব্দে আর ভয় পাইনি। ইতিমধ্যে প্রধানমন্ত্রী ও আমি যুদ্ধের নিয়ম কানুন কিছুটা রপ্ত করে ফেলেছি। তাছাড়া কোন ক্যাম্পে গেলে আমাদের জন্য যথেষ্ট নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হতো। আর বিশেষ কথা হলো আমাদের তখন মরবার ভয় ছিল না, ভয় ছিল শত্রুর হাতে যেন না পড়ি। শত্রুর হাতে না পড়ার জন্যে সতর্কতা অবলম্বন করতে হতো। কারণ, যুদ্ধাবস্থায় বন্দিত্ব মৃত্যুর চেয়ে খারাপ হতে পারে। সে সময় পঁচাগড়ের একটা সেতু মুক্তিযোদ্ধারা উড়িয়ে দেয়। সেতুর স্থান থেকে ঢাকার মাইল ষ্টোন দেখা যায়। ভাবতাম, এই পথে কখন ঢাকা যাব। বাংলাদেশের এই অঞ্চলের মুক্তাঞ্চলগুলো ছিল আমাদের আগামী দিনের মাইল পোষ্ট।

 প্রধানমন্ত্রী ও আমি পাটগ্রাম সফর করে শিলিগুড়িতে ফিরে আসি। শিলিগুড়ির মিলিটারী হাসপাতালে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের দেখতে গেলাম। আহতদের মুখে মুক্তিযুদ্ধে তাদের বীরত্বের কাহিনী শুনলাম। তাদের চোখে মুখে দেশে ফেরার স্বপ্ন। শিলিগুড়ির একটি কাকর বিছানো পথ দিয়ে আমরা পাটগ্রাম যেতাম। পাটগ্রামের পরিত্যক্ত রেল ষ্টেশনে বসে বাংলাদেশ যুদ্ধে সহায়তাকারী বন্ধু ডোনাল্ড ও ষ্টোনহাউসকে বাংলাদেশে প্রবেশের ভিসা প্রদান করি। শিলিগুড়িতে বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক কর্মচারীদের একটি প্রশাসন কাঠামো ছিল। গণসংযোগের জন্য আমি একবার শিলিগুড়ি বারে যাই।

 প্রধানমন্ত্রীর সাথেও একবার শিলিগুড়ি যাই। সারাদিন কর্মসূচি ছিল। এবার চিত্তদের বাসায় যেতে পারিনি। সন্ধ্যাবেলায় শিলিগুড়িতে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মিলিটারী ক্লাবে আমাদের নিমন্ত্রণ ছিল। এই অঞ্চলে ভারতীয় সামরিক প্রধান, তার সঙ্গী সাথী কর্মকর্তারা সকলে উপস্থিত। তাদের ব্যবহার খুবই ভাল। তাদের আলোচনায় একটি বিষয় বিশেষ ভাবে পরিস্ফুট হয়ে ওঠে। তা হলো ভারতীয় গণতন্ত্রের প্রতি তাদের অগাধ শ্রদ্ধা। গণপ্রতিনিধিদের প্রতি তাদের শ্রদ্ধাভাব দেখে আমার খুব ভাল লাগলো। বুঝলাম, সে দেশে কেন গণতন্ত্র টিকে আছে।

 পরদিন সকালে আমরা আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রশিক্ষণ ক্যাম্প পরিদর্শনে গেলাম। এগুলো ভারতীয় বাহিনীর সরাসরি তত্ত্বাবধানে। আমরা ক্যাম্পে পৌঁছে দেখি শিক্ষানবিশ মুক্তিযোদ্ধারা টার্গেট শুটিং-এ ব্যস্ত। মুক্তিযোদ্ধারা প্রশিক্ষণ শেষে লাইন করে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রীকে অভিনন্দন জানায়। জয় বাংলা শ্লোগানে পাহাড়ী এলাকায় অবস্থিত ক্যাম্প কেঁপে ওঠে। আমাদের সবার কণ্ঠে ভেসে আসলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’।

 ক্যাম্পের সীমার শেষ প্রান্তে এসে ছেলেরা আমাদের বিদায় দিয়ে গেল। এখান থেকে আমরা রংপুরের ভূরুঙ্গামারীর দিকে রওয়ানা হই। আমাদের সাথে ভারতীয় একজন বিখ্যাত আলোকচিত্র শিল্পী রয়েছে। তিনি মুক্তিযোদ্ধাদের ছবি তুলেছেন। পেছনে একটি জীপে সেই ক্যামেরা ম্যান। আমাদের সাথে অন্যান্যদের মধ্যে রয়েছেন সংস্থাপন সচিব নূরুল কাদের খান, আলোকচিত্র শিল্পী আলমসহ আরো কয়েকজন সাংবাদিক। ভূরুঙ্গামারী পৌঁছে জানলাম, এই অঞ্চলে একজন জজ (নাম সম্ভবতঃ আনোয়ার) যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।

 পরদিন আবার আমরা মুক্তাঞ্চলে যাই। এ সময় আমাদের মাঝে মধ্যে খাল, বিল, খরস্রোতা নদী ও মুক্তিযোদ্ধাদের উড়িয়ে দেয়া সেতু পার হতে হতো। একদিন প্রধামন্ত্রী ও আমি কলা গাছের ভেলায় করে একটি খাল পার হই। এই ভেলাসহ আমাদের ছবি আন্তর্জাতিকভাবে প্রচারিত হয়। পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য বই-এ এই ছবি প্রকাশিত হয়।

 এই সফর সূচিতে বিভিন্ন মুক্তাঞ্চল হয়ে বাংলাদেশের সীমান্ত ছুঁইয়ে আগরতলা পৌঁছি। কঠিন দুর্গম ও পাহাড়ী পথ। আগরতলা, সাবরুম, হরিনা, বালাট, তোরা, ভূরুঙ্গামারী, পাটগ্রাম, পঞ্চগড়, রাজশাহী, বেতায়,