পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১১৭

অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে আমেরিকার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত বাঙ্গালী আন্দোলনকারী সংগঠনগুলো সবাই উপস্থিত হয়। এই সভাতেই ডিফেন্স লীগ অব আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে জন্মলাভ করে। এক্ষেত্রে উল্লেখ্য, জনাব খানের বহু ইহুদী বন্ধু আর্থিকভাবে এই আন্দোলনকে সাহায্য করেন।

 এই সভায় আমি কয়েকটি সমস্যার কথা উল্লেখ করি। প্রথমটি হচ্ছে নিউইয়র্কে মাহমুদ আলীকে যে সাহায্য দেয়ার কথা ছিল তা দেয়া হয়নি। দ্বিতীয়তঃ কার্যনির্বাহী পরিষদের বিভিন্ন সদস্য বারবার দূতাবাসের কর্মচারীদের ওপর চাপ দিচ্ছিলেন আনুগত্য প্রকাশ করার জন্য, কিন্তু নিজেরা আমেরিকাবাসী হওয়া সত্ত্বেও ছদ্মনাম ব্যবহার করছিলেন। আমি প্রশ্ন করি যে তাঁরা যখন নিজেরাই ছদ্মনাম ব্যবহার করছেন তাহলে কিভাবে আশা করেন যে দূতাবাসের কর্মচারীরা আনুগত্য প্রকাশ করবেন। অবশ্য এখানে উল্লেখ্য যে তাদের কর্মকাণ্ড বা সিদ্ধান্তে আমি নিজে খুব একটা প্রভাবিত হইনি যেহেতু আনুগত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত আমি আগেই নিয়েছিলাম।

 এর মধ্যে দূতাবাসে আমার পদ বিলুপ্ত করা হয় এবং আমাকে পাকিস্তানে বদলী করা হয়। বস্তুতঃপক্ষে শিকাগোর সভা থেকে ফিরেই আমি এই খবর পাই। এ সংবাদ পাওয়ার পর আমি আমার সিদ্ধান্ত এবং বক্তব্য জানিয়ে সরাসরি ইয়াহিয়া খানকে একটি চিঠি লিখি। বলা বাহুল্য, এই চিঠির কোন উত্তর আমার কাছে আসেনি। ৩০শে জুন মুজিবনগর সরকারের প্রতি আমার আনুগত্য প্রকাশ করি। আমার বাসা বেসরকারীভাবে দূতাবাসে পরিণত হয় এবং আমি মুজিব নগর সরকারের পক্ষে কাজ করি। তবে আমার সিদ্ধান্তের খবর সাময়িকভাবে গোপন রাখা হয় যেহেতু আমার কিছু সহকর্মীও আনুগত্য প্রকাশ করতে আগ্রহী ছিলেন এবং তাদের কিছু সময়ের প্রয়োজন ছিল।

 জুন মাসের আরেকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ছিল কংগ্রেসে বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর শুনানী। জন রোডি ঢাকা থেকে ফিরে এই শুনানিতে স্পষ্ট বিবৃতি রাখেন। তিনি হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন সাহায্য সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করার সপক্ষে মন্তব্য রাখেন। এই শুনানী ও আরো অনেক কর্মকাণ্ড থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে মার্কিন সরকারী নীতির বিপক্ষে একটি প্রভাবশালী মহল বাংলাদেশকে সরাসরি সমর্থন করছেন। ৫ই জুলাই মুজিবনগর সরকার সমস্ত বাঙ্গালী কূটনীতিককে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের জন্য আহ্বান জানান। আমেরিকায় অবস্থিত বেশীরভাগ কূটনীতিক সিদ্ধান্ত নেন যে, আগষ্ট মাসের প্রথমদিকে মুজিব নগর সরকারের প্রতি তাঁদের আনুগত্য প্রকাশ করবেন। এই সব তথ্য আমি মুজিব নগর সরকারকে জানাই। এ সময়ের মধ্যে জনাব এনায়েত করিম দ্বিতীয়বারের মতো হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এই ঘটনা মানসিকভাবে অনেক বাঙ্গালী কূটনীতিককে দুর্বল করে দেয়। সবার মধ্যে “কি হবে কি হয়“একটা ভাব দেখা যায়। আমি মুজিব নগর সরকারকে আবার জানাই যে অবস্থার অবনতি ঘটেছে এবং অনেকে আনুগত্য প্রকাশ নাও করতে পারেন।

 এতদিন পর্যন্ত আমি জনসমক্ষে কোন বক্তব্য রাখিনি কিন্তু এই অবস্থা দেখে আমি সিদ্ধান্ত নিই যে এবার খোলাখুলি কাজ করতে হবে। সিনেটর কেনেডি আমাকে আমন্ত্রণ জানান একটি সাক্ষাৎকারে তাঁর বদলে উপস্থিত হবার জন্য। ২৭শে জুলাই এন বি সি টেলিভিশনের ‘কমেণ্টস’ অনুষ্ঠানে আমি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্যাখ্যা করি কেন পাকিস্তানের পক্ষ ত্যাগ করেছি। অনুষ্ঠানটি ১লা আগষ্ট প্রচারিত হয়।

 পাকিস্তান এ সময় কিছু বাঙ্গালীকে তাদের পক্ষে প্রচারের জন্য আমেরিকায় পাঠায়। ওয়াশিংটনে যারা এসেছিলেন তাদের মধ্যে দু’জনের সঙ্গে আমরা সাক্ষাৎ হয় জুলাই-এর প্রথম দিকে। জনাব মাহমুদ আলী তো বলে বসলেন যে গণহত্যা বলে কিছু হয়নি। শুধু দুষ্কৃতকারীরা কিছু মারা গেছে আর বাঙ্গালীরা বিহারীদের মেরেছে। তিনি আরও জানালেন যে অবস্থা আয়ত্তের মধ্যে আর শেখ মুজিবের কোন জনপ্রিয়তা নেই। আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম যে তার আত্মীয় সিলেট হাসপাতালের সুপার ডাঃ শামসুদ্দিনকে কে বা কেন হত্যা করেছে। তিনি অবলীলাক্রমে মিথ্যে কথা বললেন যে বেখেয়ালী গোলাগুলিতে তাঁর মৃত্যু হয়েছে। তিনি আমাকে দেশে ফিরতে উপদেশ দিলেন। তবে এও বললেন যে কেন্দ্রীয় সরকারে গেলে ভাল হয়। তার কথাবার্তায় আওয়ামী লীগ, আর বিশেষ করে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে তার উষ্মা ও ক্ষোভ প্রকাশ পেল। তিনি দূতাবাসের