পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/১৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
১৪২

 পরবর্তীকালে খন্দকার মোশতাকের ভূমিকা একেবারেই গৌণ হয়ে পড়ে। তিনি মুজিব নগর মন্ত্রী পরিষদের সদস্য হিসেবে বহাল থাকলেও সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী মহলে তাঁর প্রভাব একেবারেই ছিল না। যখন থেকে এই অভিযোগ সবার মধ্যে প্রচারিত হলো যে, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সরকারের অনুমতি ছাড়া যোগাযোগ করেছেন তখন তিনি প্রায় গৃহবন্দী ছিলেন। একবার তিনি গঙ্গার পারে সান্ধ্য ভ্রমণের অনুমতি চেয়েছিলেন কিন্তু ভারতীয় কর্তৃপক্ষ তা নাকচ করে দেন।

 সংসদ সদস্যদের ব্যাপারে আমার প্রশাসনিক দায়িত্ব ছিল এবং সেই সূত্রে আমি জুলাই মাসে বাগডোগরায় বাংলাদেশের সংসদ সদস্যদের সভায় উপস্থিত ছিলাম। সেখানে যে অবস্থার সৃষ্টি হয় তা দেখে বিচলিত হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। সদস্যরা নানাদলে-উপদলে বিভক্ত ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সবার মনোভাব সমানভাবে সুদৃঢ় ছিল না। এমনকি অনেক সংসদ সদস্য ও নেতারা পাকিস্তানে ফিরে গিয়ে আপোষ করার পক্ষেও মত প্রদান করেন। এইসব দেখে আমার মনে হচ্ছিল যে, এরা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে হয়তো বা সবকিছু ভণ্ডুল করে ফেলতে পারেন। একক উদ্দেশ্যে সবাই কাজ করছিলেন না। পরবর্তীকালে অবশ্য ভারতীয় রণনীতির পাশে এইসব প্রশ্নের আপেক্ষিক গুরুত্ব কমে আসে।

 বামপন্থী রাজনৈতিক সংগঠন ও ব্যক্তিদের প্রতি আওয়ামী লীগের মনোভাব বৈরী ছিল। নীতি হিসেবে নয় কিন্তু বহু আওয়ামী লীগ নেতা এদের বিরোধিতা করতেন। যেমন শিবপুর এলাকায় বামপন্থী নেতা মান্নান ভূঁইয়া একটি মুক্ত অঞ্চল গড়ে তোলেন। এটি অনেক আওয়ামী লীগের লোকজন সহ্য করতে পারতেন না। এমনকি অবস্থা এক পর্যায়ে এতই খারাপ হয়েছিল যে, বহু সদস্য সরকারের কাছে দাবী তোলেন যে, মান্নান ভূঁইয়াকে হত্যা করা হোক এবং তাঁর সংগঠন ধ্বংস করে দেয়া হোক। অন্য একটি ঘটনা যেটা এখানে উল্লেখ করা যায় সেটি হচ্ছে, কিছু সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ইসরাইলের অনুপ্রবেশের চেষ্টা। ইসরাইল সরকার ভারতীয় ডানপন্থী রাজনীতিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। তাঁরা আবার বাংলাদেশের কিছু সংসদ সদস্যের মাধ্যমে ইসরাইলী সাহয্যের প্রস্তাব নিয়ে আসেন। ব্যাপারটা আমার কাছে খুবই খারাপ ঠেকে এবং আমি সরকারী কর্মচারীর দায়িত্ব বহির্ভূত একটি কাজ করি। আমি তথ্যটি সিপিএম-এর পত্রিকায় জানিয়ে দিই এবং খবরটি এ পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এর ফলে ইসরাইলী লবীর তৎপরতা বন্ধ হয়ে যায়।

 কলকাতায় মাওলানা ভাসানীর সংগেও আমার দেখা হয়। তাঁর অবস্থা মোটেই ভালো ছিল না। তাঁর দেখাশুনা করার জন্য কেউ কোন ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। সেপ্টেম্বর মাসের দিকে তিনি কলকাতায় ছিলেন এক প্রকার বন্দীর মত। আমি নিজে থেকেই তাঁর কাপড়-চোপড়ের ব্যবস্থা করি। একটি ব্যাপার বেশ মনে পড়ে। তিনি এসবের মধ্যেও তাল টুপির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন। আমি সারা কলকাতা খুঁজে তাঁর জন্য এই টুপি সংগ্রহ করি।

 এছাড়া মওলানা ভাসানীর বিভিন্ন বক্তব্য আমি মানুষের কাছে পৌঁছে দিতাম এবং অনেক ক্ষেত্রে তাঁর কাছে খবর নিয়ে যেতাম। যথা-উপদেষ্টা পরিয়দের সদস্য হওয়ার অনুরোধ খন্দকার মোশতাকের পক্ষ থেকে আমি বহন করি। খন্দকার মোশতাক অবশ্য চেয়েছিলেন যে, মওলানা ভাসানী যদি এই পরিষদের সদস্য হন, তবে তাঁর নিজস্ব মতামত ভারতবিরোধী জাতীয়তাবাদ, আরো শক্তিশালী হবে। সে সময়ে অবশ্য খন্দকার মোশতাকের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়েছিল।

 ডিসেম্বর মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সব জল্পনা-কল্পনা এবং কোন্দলের সমাপ্তি ঘটে। ১৬ তারিখ দেশ স্বাধীন হয় এবং ১৮ তারিখ খুলনায় ডি, সি, হিসেবে যোগদান করি।

ডঃ কামাল সিদ্দিকী
মার্চ, ১৯৮৪।