পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/২৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৪২

শেষবারের মতো দেখতে। ঠিক বেলা ১০টা যে সময় সভা অনুষ্ঠানের কথা ছিল তখন আমি শিবিরে। ১০ টা বেজে ১৫ মিনিটের সময় সীমান্ত থেকে পাক সৈন্যরা শেলিং শুরু করল। টার্গেট আমাদের সভাস্থল। তাঁরা বোধহয় পূর্বাহ্নেই খবর পেয়ে গিয়েছিল। রাধিকাপুর স্টেশন ঘরের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হল এবং কয়েকজন লোকও মারা গেল। সেখানে ঐ সভার নেতৃবৃন্দ পরিস্থিতি নিয়ে, উদ্বাস্তুদের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করলেন। মুক্তিযোদ্ধাদের বিষয়টিই বিশেষ গুরুত্বলাভ করল। অনেক সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন তাঁদের জন্য ক্যাম্পের ব্যবস্থা, খাওয়া-দাওয়া অস্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

 দুই তিন দির পর ফিরে গেলাম কোলকাতায়। সেখানে একটা যোগাযোগের অফিসের প্রয়োজনীয়তা তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছিল। মুক্তিসংগ্রাম সহায়ক সমিতির প্রচেষ্টায় ৩/১ ক্যামাক স্ট্রীটে অফিস ঘর পাওয়া গেল। আমি সেই অফিসের দায়িত্ব নিলাম। আমাকে বিশেষভাবে সাহায্য করলেন ব্যারিষ্টার বাদল রশীদ। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে এটাই সর্বপ্রথম সংযোগ রক্ষাকারী অফিস। ক্যামাক স্ট্রীটে স্থান সংকুলান না হওয়ায় ৪৫ প্রিন্সেস স্ট্রীটে অফিস স্থানান্তরিত করা হয়। আমাকে তখন দায়িত্ব দেয়া হয়েছে। মুজিবনগর সরকারের ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন জনাব কামরুজ্জামান সাহেব - আমি অনারারী মহাসচিব। আমাদের সাহায্য করার জন্য এই অফিসেই বসতেন সর্বজনাব আব্দুল মালেক উকিল, মোঃ সোহরাব হোসেন, আব্দুর রব সেরনিয়াবত, ব্যারিস্টার বাদল রশীদ, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন প্রমুখ নেতৃবৃন্দ।

 এই মন্ত্রণালয়ের অধীনে, ‘যুব অভ্যর্থনা শিবির’ স্থাপন করা হল। এগুলির কাজ ছিল সীমান্ত অতিক্রম করে আসা যুবকদের জন্য আহার বাসস্থানের ব্যবস্থা করা, ক্লাস নেয়া, শরীরকে সুস্থ রাখার জন্য পিটিসহ অন্যান্য শারীরিক কসরত ও হালকা অস্ত্র পরিচালনা শিক্ষা করা। ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রীকে এই দায়িত্ব পালনের জন্য মটিভেটর নিয়োগ, তাঁবু-বিছানা-বালিশ, কাপড়-চোপড়, রান্নার যাবতীয় সরঞ্জাম ও নিয়মিত রেশন সরবরাহ করতে হয়েছে। শিবির পরিচালকও আমরা নিয়োগ করতাম। মহাসচিব হিসেবে আমাকে এই শিবিরগুলিতে অর্থসহ যাবতীয় সরবরাহ প্রথমে সরাসরি এবং পরে জোনাল কাউন্সিলের মাধ্যমে করতে হত।

 এছাড়াও আমাদের দায়িত্ব ছিল সীমান্ত বরাবর উদ্বাস্তু শিবিরগুলির বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে ভারত সরকারসহ বিভিন্ন বিদেশী রাষ্ট্র এবং সাহায্যদাতা সংস্থার সরঙ্গ যোগাযোগ করা। উদ্বাস্তুদের কার্ড ও অন্যান্য বস্তু সরবরাহের দায়িত্ব আমাদেরই পালন করতে হত। মূল কথা, যেহেতু, এই সময় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবি, শিল্পী, সরকারী কর্মচারীসহ বিভিন্ন স্তরের উদ্বাস্তুদের রিলিফের প্রয়োজন ছিল সুতরাং স্বাভাবিকভাবেই এই অফিসকে সবদিকেই দৃষ্টি রাখতে হত।

 যুব অভ্যর্থনা শিবির ছাড়াও তৎকালীন সশস্ত্র বাহিনী, ইপিআর, আসার মুজাহিদ যাঁরা প্রথম থেকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত ছিলেন (কারণ তাঁরা ছিলেন শিক্ষাপ্রাপ্ত এবং প্রশিক্ষণের প্রয়োজন ছিল না) তাঁদের শিবিরগুলির দায়িত্বও আমাদের মন্ত্রীকে নিতে হয়েছে, তাঁদের কাপড়-চোপড়, খাওয়া-দাওয়াসহ যাবতীয় সরবরাহ আমাদেরকেই করতে হয়েছে। এরপর এসেছে ‘যুব শিবির' প্রকল্পটির ধারণা। এর মূল উদ্ভাবক ভারতের তৎকালীন কেন্দীয় শিক্ষা মন্ত্রী ডঃ ত্রিগুণা চরণ সেন। স্থির হল যুব অভ্যর্থনা শিবির থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বাছাই করে এই যুব শিবিরে আনতে হবে। সেখানে উচ্চতর মোটিভেশনসহ মাঝারি ধরনের অস্ত্র পরিচালনা প্রশিক্ষণ দিতে হবে। সেখান থেকে সরাসরি তাদেরকে অস্ত্র দিয়ে গেরিলা হিসেবে দেশের ভেতরে প্রেরণ করা হবে কিংবা কেউ যদি আরো উচ্চতর ভারী অস্ত্রের প্রশিক্ষণ করতে চায়, তাঁদের জন্য ভারতের বিভিন্ন স্থানে ‘প্রশিক্ষণ শিবির' নামে আরো কয়েকটি শিবির স্থাপন করা হয়। এসব যুব শিবির সরাসরি আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকলেও এগুলোতে প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন ও মেজর পর্যায়ের অফিসারবৃন্দ। এগুলির পরিচালনা ও নিয়োগ-এর জন্য গঠন করা হয় ‘Board of Control Youth Camps'। আমাকে এর চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। সদস্য ছিলেন (১) ডঃ মফিজ চৌধুরী, (২) ক্যাপ্টেন করীম, (৩) শ্রী গৌর চন্দ্র বালা। সচিব ছিলেন তৎকালীন সিএসপি জনাব নুরুল কাদের খান। ডিজি ছিলেন উইং কমাণ্ডার