পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৩

প্রদানের অনুরোধ জানাই যাতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী, তার নিজস্ব পৃথক সত্তা নিয়ে অপারেট করতে পারে। কারণ আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈমানিক ও টেকনিশিয়ানের কোন অভাব ছিল না।

 এর কিছুদিন পর কলকাতায় ভারতীয় বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পি সি লালের সাথে আবার আমার এ ব্যাপারে আলোচনা হয়। এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা ভারতীয় বিমান বাহিনী থেকে অটার এয়ারক্রাফট, হেলিকপ্টার এবং একটি ডাকোটা বিমান পাই। এই বিমানগুলো নিয়েই সম্পূর্ণভাবে আমাদের নিজস্ব পাইলট ও টেকনিশিয়ানদের নিয়ে ১৯৭১সালের ২৮শে সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যাণ্ডের ডিমাপুর বিমান ঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হয়। সে সময় উইং কমাণ্ডার বাশার ৬নং সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন এবং ফ্লাইট লেঃ লিয়াকত ও ফ্লাইট লেঃ নূরুল কাদের তখন ৪ এবং ৫নং সেক্টরে সেনাবহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশ নিচ্ছিলেন। এরা ছাড়া বাকী সকল বৈমানিক বিমান বাহিনীর সাথে যুক্ত থাকে।

 স্কোয়াড্রন লীডার সুলতান মাহমুদ (বর্তমানে বিমান বাহিনী প্রধান) তখন ১নং সেক্টরের সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। আমি তাঁকে সেখান থেকে ডিমাপুর নিয়ে আসি এবং বিমান বাহিনীর প্রশাসনিক ও ‘অপারেশন’-এর দায়িত্ব তাঁর ওপর দিই।

 যেহেতু আমাদের সম্পদ ও জনবল খুবই সীমিত ছিল সেহেতু বিমান যুদ্ধের কৌশল হিসেবে আমরা দুটো পন্থা অবলম্বন করি। প্রথমত কেবলমাত্র রাতের বেলায় অপারেশন পরিচালনা করা এবং দ্বিতীয়তঃ আমরা যাতে পাকবাহিনীর রাডারে ধরা না পড়ি সেজন্য খুব নীচু দিয়ে উড্ডয়ন করা।

 নাগাল্যাণ্ড এক বিস্তীর্ণ জংগলাকীর্ণ পার্বত্য এলাকা। সুতরাং লক্ষ্যবস্তু ঠিক করে নিয়মিত অনুশীলন করা আমাদের পক্ষে খুবই অসুবিধাজনক ছিল। তাই একটা পাহাড়ের ওপর সাদা প্যারাসুট ফেলে সেটাকে লক্ষ্যবস্তু ধরে আমরা অনুশীলনের ব্যবস্থা করি যাতে রাতের বেলায়ও দেখা যায়।

 ৩রা ডিসেম্বর সার্বিক যুদ্ধ শুরু হলে আমাদের এই ক্ষুদ্র বিমান বাহিনী চট্টগ্রাম ও গোদনাইলে প্রথম আঘাত হানে এবং পাক বাহিনীর মারাত্মক ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয়।

 মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর ডেপুটি চীফ অব ষ্টাফ হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন দিক প্রত্যক্ষ করার দুর্লভ সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। আমাদের তরুণেরা প্রায় বিনা অস্ত্রে অথবা অতি সাধারণ অস্ত্র নিয়ে কেমন করে অতি আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত একটা বাহিনীর সাথে অসীম সাহস নিয়ে মোকাবেলা করেছিল এবং কেমন করে স্বাধীনতা ছিনিয়ে এনেছিল তার বহু ছোট ছোট ঘটনা আজও আমার স্মৃতিতে অম্লান হয়ে আছে। এখানে আমি বহু ঘটনা থেকে একটা মাত্র ঘটনার উল্লেখ করছি।

 যুদ্ধ চলাকালে পাকবাহিনীর জন্য প্রয়োজনীয় বস্ত্রসামগ্রী বিশেষ করে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করে দেয়ার লক্ষ্যে আমরা চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরকে অকেজো করে দেয়ার একটা পরিকল্পনা নিই। আমরা সিদ্ধান্তে উপনিত হয়েছিলাম যে, যদি নৌ-কামাণ্ডো পাঠিয়ে পাকিস্তানী বা তাদের মিত্রদের কিছুসংখ্যক জাহাজ ডুবিয়ে দিতে পারি তবে এতে চমৎকার ফল পাওয়া যাবে। ডুবে যাওয়া জাহাজ একদিকে বন্দরের প্রবেশপথকে বন্ধ করে দেবে এবং মানসিক দিক থেকেও অন্য কোন জাহাজ সে পথে যেতে সাহসী হবে না।

 এই লক্ষ্যকে সামনে রেখে জুন মাস থেকে প্রায় ১৫০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে মুর্শিদাবাদের পলাশীতে নৌ-কমাণ্ডোর প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এই পরিকল্পনার আওতায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ১৩/১৪ বছর বয়সের একটি কিশোর ডুব-সাঁতার দিয়ে চালনা বন্দরের একটি পাকিস্তানী জাহাজে মাইন ফিট করতে যায় কিন্তু ভ্রান্তিবশত সে একটি চায়নিজ জাহাজের কাছে চলে যায় এবং ওদের হাতে ধরা পড়ে। পরে বহু জিজ্ঞাসাবাদের পর তারা তাকে মুক্তি দেয়। ফিরে এসে অবলীলায় সে তার মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে আসার বর্ণনা দিয়েছিল সবার কাছে। মুক্তিপাগল