পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
২৪

এই কিশোরের সাহস, দৃঢ়তা ও দেশপ্রেমের দৃষ্টান্তে সেদিন আমরা সবাই বিস্মিত হয়েছিলাম। এই ঘটনা একটা একক বিচ্ছিন্ন কোন ঘটনা নয়-এ রকম হাজার হাজার নজীর সেদিন আমাদের ছেলেরা স্থাপন করেছে।

 মে মাসে পরিস্থিতি বিশ্লেষণের পর আমার পরিস্কার একটা ধারণা হয়েছিল যে, ডিসেম্বরের শেষ নাগাদ দেশ পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হবে। আমার ঐ ধারণার পেছনে প্রধানতঃ তিনটি কারণ ছিল। প্রথমতঃ যে বিপুল পরিমাণ শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল তারা অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দিক থেকে ভারতের পক্ষে একটা বিরাট সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়। সুতরাং যত শীঘ্র এর একটা সমাধানের পথ বের করার জন্য ভারত উদগ্রীব ছিল।

 দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের দুই অংশকে আলাদা করে দেয়ার যে কামনা ভারতের ছিল তাকে সফল করে তোলার এটাই ছিল সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। সুতরাং ভারত এ সুযোগের পূর্ণ ব্যবহার করবে। তৃতীয়তঃ ভারত এটা বুঝতে পেরেছিল যে, বাইরের বিশেষ করে চীনের তরফ থেকে হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যায় না। সুতরাং যুদ্ধে যদি ভারতকে নামতেই হয় তাহলে এমন একটা সময় বেছে নিতে হবে যাতে চীনের পক্ষে যুদ্ধে অংশগ্রহণ অসম্ভব হয়ে পড়ে। নভেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত ভারত-চীন এলাকায় প্রচণ্ড শীত ও তুষারপাতের ফলে চীনা সৈন্যদের ব্যাপারে চূড়ান্ত ফয়সালা করে নেয়ার ব্যাপারে ভারতের চেষ্টা করাই স্বাভাবিক।

 কেবল ভারতীয় সাহায্যের কথা চিন্তা করেই আমি এ ধারণা পোষণ করিনি। ইতিমধ্যে দেশের জনসাধারণের অকুণ্ঠ সমর্থন ও সহযোগিতা পেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোবল একদিকে যেমন বৃদ্ধি পেয়েছিল তেমনি শত্রুকে চরম আঘাত হানার শক্তিও তাদের দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অপরদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণে এবং দেশের ভেতরে কোটি কোটি বৈরীভাবাপন্ন মানুষের অসহযোগিতা ও প্রতিরোধ পাকবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে হতোদ্যম ও পরিশ্রান্ত করে তুলেছিল।

 অবশেষে আমাদের সেই বহু কাঙ্ক্ষিত সময়, শত্রুর পূর্ণ আত্মসমর্পণের সময় ঘনিয়ে এল। ১৬ই ডিসেম্বরের সকাল বেলা। পাক-বাহিণীর আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্তের কথা ইতিমধ্যে এসে গেছে। এমন সময় খবর পেলাম বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ কেবিনেটের মিটিং বসেছে এবং আমাকে ওখানে জরুরী কোন বিষয়ে আলোচনার জন্য খোঁজ করা হচ্ছে। কর্নেল ওসমানী তখন সীমান্তের অগ্রবর্তী এলাকা পরিদর্শনের জন্য সিলেটে ছিলেন। সুতুরাং সেই অল্প সময়ে তার সঙ্গে চেষ্টা করেও যোগাযোগ স্থাপন করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি।

 আমাকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন জানালেন, যে বিকেলে ঢাকায় পাকবাহিনী আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে এবং কর্নেল ওসমানীর অনুপস্থিতিতে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সবচেয়ে সিনিয়র অফিসার হওয়ায় উক্ত অনুষ্ঠানে আমাকে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করতে হবে। তদনুসারে জেনারেল অরোরার সঙ্গে বিমানে আগরতলা, এবং ওখান থেকে হেলিকপ্টারে ঢাকা এসে পৌঁছলাম। জেনারেল অরোরা ছিলেন সম্মিলিত বাহিনীর কমাণ্ডার।

 আত্মসমর্পণের দলিলে কেবলমাত্র দু’জনের স্বাক্ষর দানের ব্যবস্থা ছিল একজন পাক বাহিনীর পূর্বঞ্চলীয় এলাকার প্রধান এবং অন্যজন ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক।

 অনুষ্ঠানে পাক-বাহিনী প্রধান বিষণ্ণ, ভগ্নপ্রায় ও অশ্রুসিক্ত জেনারেল নিয়াজীকে দেখলাম। যাথাসময়ে উভয় পক্ষের স্বাক্ষর হয়ে গেল। চূড়ান্ত বিজয়ের মাধ্যমে সমাপ্তি ঘটলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের।

আব্দুল করিম খন্দকার

(এয়ার ভাইস মার্শাল, অবসরপ্রাপ্ত)

আগস্ট, ১৯৮৪।