পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৩৩

পরিত্যক্ত হয়ে যাবে এই ভেবে পরিত্যক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোকে সরকারী নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যবস্থা করা হবে। দেশী মালিকানায় শিল্প বা ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান যেগুলো দীর্ঘদিন যাবত বৈষম্যের শিকার হয়েছিল তাদেরকে সকল সুযোগ-সুবিধা দিয়ে চাঙ্গা ও তেজী করে তুলতে হবে। এই ছিল আমাদের অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত। এ ছাড়া, বিরাট মুক্তিবাহিনীকে যথাশীঘ্র কি করে কৃষি বা অন্যান্য ক্ষেত্রে ফিরিয়ে নেয়া যায় তারও ব্যবস্থা করা হবে। অগণিত ছাত্র-শিক্ষক যারা মুক্তিযুদ্ধে জড়িত হয়ে পড়েছে তাদেরকে শান্তিময় জীবনের অভীষ্ঠ মন-মানসিকতায় কিভাবে রূপান্তরিত করা যায় সে দায়িত্ব শিক্ষাবিদদের হাতেই ছেড়ে দেয়া হবে। স্বাধীনতার জন্য ত্যাগ হিসেবে ছাত্র-জীবন থেকে একটি বছর দেবার কথাও তখন চিন্তা করা হয়েছিল যাতে শিক্ষা ব্যবস্থায় কোন মহা সংকটের উদ্ভব না ঘটে।

 অর্থনৈতিক পুনর্বাসন এবং সামাজিক শৃঙ্খলার বিধানকল্পে কঠোর প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা আইনসংগত উপায়ে গৃহীত হবে। অর্থনৈতিক, সামাজিক ও প্রশাসনিক কোন নতুন সংস্কারে সঙ্গে সঙ্গে হাত দেয়া হবে না। মুজিব নগর সরকার একটি পরিকল্পনা কমিশন গঠন করেছিল। এই কমিশনে যাঁরা ছিলেন তাঁদের মধ্যে অধ্যাপক মোশারফ হোসেন, অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ চৌধুরী ও তাঁদের নির্বাচিত আরো কয়েকজন। যতটুকু মনে পড়ে একটা যুদ্ধোত্তর গরীব দেশের জনসাধারণের খাদ্য-গৃহ ও বস্ত্রসংস্থান ছিল এই পরিকল্পনার মৌল বিষয়।

 স্বাধীনতা যুদ্ধের মাসগুলোয় পাকিস্তানী একশত টাকার বিনিময়ে একশত চুয়াল্লিশ ভারতীয় টাকা পাওয়া যায়নি। সমান সমান মূল্যে মুদ্রা বিনিময় হতো। মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ বেতন ছিল চারশত পাকিস্তানী টাকা। এই টাকা দিয়ে বাড়ী ভাড়া, খাওয়া, অফিসে যাতায়াত, ঔষধ ইত্যাদি বাবদ যাবতীয় খরচ মেটানো হতো। অর্থ ছিল না বলে ব্যয়বহুল নিয়মিত বাহিনী বড় আকারে গড়ে তোলা সম্ভব হয়নি। রিফিউজি ক্যাম্পে খেয়েদেয়ে অধিকাংশ মুক্তিযোদ্ধা বিভিন্ন সেক্টরে অভিযান চালিয়েছে। কি অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে দিন কাটিয়েছি তা ভাবলে অবাক হতে হয়। ঢাকা থেকে লোক মারফত কিছু টাকা পয়সা নেবার ব্যবস্থা শেষ পর্যন্ত করতে হয়েছে। আমার শ্বশুর মরহুম হাফিজুদ্দিন সাহেব এই টাকা দেন। আমার বন্ধু অধ্যাপক মোস্তফা নূরুল ইসলাম বিলেতে ছিলেন তিনিও কিছু পাউণ্ড দিয়ে সাহয্য করেন। তাঁদেরকে এই টাকা ফেরত দিতে হয়নি। লক্ষ লক্ষ মানুষ কি অভাবনীয় কষ্টে দিন কাটিয়েছে তা বলে শেষ করা যাবে না।

 কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র ও রিলিফের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে সীমান্তের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্ত পর্যন্ত ভ্রমণ করেন। অধিকাংশ সময় আমি তাঁর সঙ্গে ছিলাম। আমি বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে সেক্টর কমাণ্ডারদের সঙ্গে আলাপ করে তাদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করেছি। ভারতীয় প্রশাসনের কাছে ক্যাম্পের বিবিধ সমস্যা তুলে ধরেছি। মুক্তিযোদ্ধা বেশে পাকিস্তানী চরদের অনুপ্রবেশ প্রতিহত করার কাজে আমাদের পুলিশ ও অন্যান্য কর্মচারীদেরকেও স্থানে স্থানে খবর সংগ্রহ করতে হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের বিশাল আবর্তে আমার কাজের কোন ধরাবাঁধা পরিধি ছিল না বলা চলে। স্থানে স্থানে জোরালো বক্তৃতা দিয়েছি। সমাজতন্ত্রের মর্মবাণী ব্যাখ্যা করে মুক্তিবাহিনীকে উদ্বুদ্ধ করার কাজে কামরুজ্জামান ও তাজউদ্দিন ছিলেন সোচ্চার। স্বদেশী গান গেয়ে দেশপ্রেমিক শিল্পীরা স্বাধীনতা যুদ্ধকে দেশ-বিদেশ প্রচার করেছেন। মাত্র করয়কজন শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বেতারকর্মী যে প্রচারকার্য চালিয়েছেন তা অভাবনীয়। মুকুলের ““ঠেটা মালিক্কা”“(গভর্নর ডঃ আব্দুল মোত্তালিব মালিক) নামক প্রোগ্রাম ও ““চরম পত্র”“ছিল সে সময়ের বেতার জগতের অবিস্মরণীয় আলেখ্য। কামরুল হাসান, জহীর রায়হান, হাসান ইমাম, আব্দুল জববার, মুকুল এবং আরো অনেককে আমি আগে থেকে খুব ভালভাবে জানতাম। তাঁদেরকে অনেক খবর দিয়েছি যা নিজ নিজ পদ্ধতিতে তারা ব্যবহার করেছেন। যুদ্ধের বিভিন্ন অঙ্গনের দৈনিক খবর সংগ্রহের ব্যবস্থা আমরা করেছিলাম। আমাদের লোকজন ঢাকা প্রশাসনের সব গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র সেক্রেটারিয়েট থেকে সংগ্রহ করে কলকাতায় আমাদের কাছে পৌঁছে দিত। রিলে সিস্টেমে এই সব খবর পাঠানো হত। সপ্তাহকালের মধ্যে কলকাতা থেকে আমাদের গোয়েন্দারা ঢাকা ও অন্যান্য শহরের অফিসের গোপনীয় কাগজপত্র, পাকিস্তান সরকারের আদেশ নির্দেশ ইত্যাদি সংগ্রহ করে ফিরে আসতো। অফিসের লোকজন গোপনে গুরুত্বপূর্ণ খবর সরবরাহ করে আমাদেরকে সাহয্য করেছে। মুক্তিকামী ছিল বলেই তারা