পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৬৬

চারদিক জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা অবরোধ করে রেখেছে। হাজার হাজার লোক বজ্রকণ্ঠে শ্লোগান দিচ্ছে সেনানিবাস পুড়ে দেয়ার জন্য। জনতার হাতে বন্দুক, রাইফেল, বল্লম, বর্শা, দা, কুড়ালসহ স্থানীয় অস্ত্রশস্ত্র। কুষ্টিয়াতে তিন শতাধিক পাক সেনা মুক্তিবাহিনী দ্বারা অবরুদ্ধ।

 কুষ্টিয়া ঝিনাইদহ থেকে ২৮ মাইল দূরে। চুয়াডাঙ্গায় মেজর ওসমান মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে রয়েছেন। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে যোগ দিয়েছেন। চুয়াডাঙ্গার অবাঙ্গালী মহকুমা প্রশাসককে হত্যা করা হয়েছে। কুষ্টিয়ার অবাঙ্গালী জেলা প্রশাসক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দী। আমরা চুয়াডাঙ্গায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেই। কুষ্টিয়ার অবরোধ জোরদার করার পরিকল্পনা নেয়া হয়। বিভিন্ন জরুরি নির্দেশ দিয়ে আমরা দুইজন ও মাহবুব চুয়াডাঙ্গা চলে যাই। সেখানে পৌঁছে তওফিক এলাহী ও মেজর ওসমানের সাথে ব্যপক আলোচনা হয়। চুয়াডাঙ্গার সকল আওয়ামী লীগ কর্মীকে সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করি। ইতিমধ্যে আমরা চুয়াডাঙ্গা থেকে একটি বিডিআর বাহিনী কুষ্টিয়া প্রেরণ করি।

 কুষ্টিয়াতে পাক সেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। গ্রাম থেকে অগণিত লোক শহরে আসে। হাজার হাজার মানুষের শ্লোগানে শহর কেঁপে ওঠে। মানুষের হাতে বিভিন্ন শ্রেণীর সাধারণ অস্ত্র। পুলিশের সকল রাইফেল মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। অবাঙ্গালী এডিসি সার্কিট হাউজে পাক সেনাদের সাথে অবরুদ্ধ। এডিসি নিহত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধাদের গুলিতে। তিনি একজন পাক জেনারেলের আত্মীয়।

 কুষ্টিয়ার সর্বশ্রেণীর লোক যুদ্ধে অংশ নেয়। এমনকি মেয়েরা পর্যন্ত। সাধারণ মানুষ মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ভাত, ডিম, রুটি, পিঠা, মিষ্টি ইত্যাদি পাঠায়। আমাদের অগণিত সৈনিকদের রসদের কোন অভাব হয়নি। ঝিনাইদহ থেকে খবর পাই, কিছুসংখ্যক পাক সৈন্য ভয়ে পালিয়ে গেছে।

 সারাগঞ্জ ব্রিজ আমার বাড়ির পাশে। যশোর-কুষ্টিয়ার মধ্যে সংযোগকারী রাস্তার ওপর এই ব্রীজ দিয়েই যশোর থেকে পাক বাহিনী কুষ্টিয়া আসতে পারে। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধারা ব্রীজের পাশে মাটি কেটে এর উপর চট বিছিয়ে দেয়। চটের মধ্যে আলকাতরা দিয়ে রাস্তার পিচের মত কালো করা হয়। কুষ্টিয়া থেকে পাক সেনাদের একটি পলাতক জীপ সেই খাদে পড়ে যায়। গ্রামের লোক ওদের পিটিয়ে মারে। এমনিভাবে কুষ্টিয়ার গ্রামের মানুষ পালিয়ে যাওয়া পাক সেনাদের পিটিয়ে মারে।

 চুয়াডাঙ্গা থেকে খবর পাই, কুষ্টিয়াতে আমরা জয়ী হয়েছি। ওরা অস্ত্রশস্ত্র ফেলে পলায়নোন্মুখ। এদের একজনও যশোর সেনানিবাসে ফিরে যেতে পারেনি। দুপুরে চুয়াডাঙ্গা থেকে কুষ্টিয়ার বীর জনতার প্রতি একটি অভিনন্দন বাণী পাঠাই। আমার এই বিবৃতি ভারতের কয়েকটি কাগজে প্রকাশিত হয়।

 চুয়াডাঙ্গা গিয়ে তিন ভাগে বৈঠক করি। একটি রাজনৈতিক, একটি সামরিক ও অপর বৈঠকটি করি তওফিক ও মাহবুবকে নিয়ে। তওফিক একাধারে চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক। সেখানে বসে পাবনার খবর পাই। সেখানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের যোগ দিয়েছেন। মাগুরা, ঝিনাইদহ, ফরিদপুরে আমাদের অবস্থা ভাল। যশোর সেনানিবাস বীর জনতার দ্বারা তখনো অবরুদ্ধ।

 ঢাকার অবস্থা আমরা স্বচক্ষে দেখেছি। চট্টগ্রামের খবর বিপ্লবী বেতারযোগে পেয়েছি। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো, সারা বাংলায় গণযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে এই যুদ্ধ চলছে। বাংলার সেনাবাহিনী, বিডিআর, পুলিশসহ সর্বশ্রেণীর লোক সংগ্রামে অংশ নিয়েছে। বীর জনতার মনোবল থেকে আমরা বিশেষভাবে আশান্বিত। বিভিন্ন স্থানে খণ্ড যুদ্ধে আমরা জয়ী হলেও বিশাল পাক বাহিনীর সাথে লড়াই করার মত অস্ত্রসম্ভার এই মুহূর্তে আমাদের নেই। তবে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে জনতার শক্তি দানা বেঁধে উঠেছে, একে সুসংহত করতে হবে। জনযুদ্ধের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে যোদ্ধাদের হাতে প্রয়োজনীয় অস্ত্র তুলে দিতে হবে। শত্রুর কাছ থেকে কেড়ে নেয়ার কৌশল আমাদের যোদ্ধাদের শিখাতে হবে।