পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চদশ খণ্ড).pdf/৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা হয়েছে, কিন্তু বৈধকরণ করা হয়নি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চদশ খণ্ড
৭৪

স্ট্রীটে একটি বৈঠক করেছেন। আর এতে ভালভাবে সুর মিলিয়েছেন মিজানুর রহমান চৌধুরী। তাজউদ্দিন ভাই আমাকে ডেকে বললেন, আপনাকে আগেই বলেছিলাম এই দল দিয়ে কি স্বাধীনতা যুদ্ধ হবে?

 আমরা বিএসএফ-এর লর্ড সিনহা রোডের একটি অফিসে অবস্থান করছি। ভারত সরকার আমাদের নিরাপত্তার জন্য বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। আমরা ভারতের মাটিতে, ইন্দিরা গান্ধীর সরকার এই কথা প্রকাশ করতে রাজী নয়।

 আমাদের নেতাদের বিভিন্নমুখী বৈঠকে তাজউদ্দিন ভাই ও আমি বিশেষভাবে বিব্রতবোধ করছি। কামরুজ্জামান ভাই খুবই সুবিবেচক মানুষ। তিনি ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা বললেন। রাতের বেলা লর্ড সিনহা রোডে আমাদের বৈঠক বসল। উপস্থিত বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন কামরুজ্জামান, মিজান চৌধুরী, শেখ মনি, তোফায়েল আহমদ ও আরও অনেকে। শেখ মনি তাঁর বক্তৃতায় বলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু হয়েছে, বঙ্গবন্ধু শত্রুশিবিরে বন্দী, বংলার যুবকরা বুকের তাজা রক্ত দিচ্ছে, এখন কোন মন্ত্রীসভা গঠন করা চলবে না।

 মন্ত্রী-মন্ত্রী খেলা এখন সাজে না। এখন যুদ্ধের সময়। সকলকে রণক্ষেত্রে যেতে হবে। রণক্ষেত্রে গড়ে উঠবে আসল নেতৃত্ব। এই যুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করতে হবে।

 তাজউদ্দিন ভাই ও আমি ছাড়া বৈঠকে উপস্থিত প্রায় সকলে শেখ মনির বক্তব্য সমর্থন করেন। তাজউদ্দিন ভাই যেহেতু নিজে প্রধানমন্ত্রী হতে যাচ্ছেন, তাঁর পক্ষে পাল্টা জবাব দেয়া সম্ভব নয়। তাই শেষ পর্যন্ত আমাকেই উঠে দাঁড়াতে হলো। উপস্থিত প্রায় সকলেরই ধারণা ছিল আমি ও তাজউদ্দিন ভাই আগেভাগে দিল্লী গিয়েছি ক্ষমতা কুক্ষীগত করার জন্য।

 আমি আমাদের দিল্লী যাওয়ার সমর্থনে ও শেখ মনির বক্তব্যের কয়েকটি যুক্তি পেশ করি। আমার প্রথম যুক্তি ছিল, দিল্লী যাত্রার পূর্বে আমাদের জানা ছিল না কারা বেচেঁ আছেন এবং কাকে কোথায় পাওয়া যাবে। দ্বিতীয় যুক্তি হলো, ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দিন ভাই দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলেছেন। দলের সভাপতি বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সাধরণ সম্পাদক হিসেবে কথা বলার এখতিয়ার তাজউদ্দিন ভাইয়ের রয়েছে। তাছাড়া ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রাথমিক আলোচনা হয়েছে মাত্র। ভবিষ্যতে আরও আলোচনা হবে। তখন দলের অন্যান্য নেতৃবৃন্দ অংশগ্রহণ করতে সমর্থ হবেন। তৃতীয়ত আমরা বঙ্গবন্ধু নিয়োজিত হাই কম্যাণ্ড নিয়ে অস্থায়ী সরকারের মন্ত্রীসভা গঠনের পরিকল্পনা করেছি মাত্র।

 আমি আরও বললাম, বাংলাদেশ বার ভূঁইয়ার দেশ। বারটি বিপ্লবী কাউন্সিল গড়ে ওঠা বিচিত্র কিছু নয়। আমাদের অবশ্যই আইনগত সরকার দরকার। কেননা, আইনগত সরকার ছাড়া কোন বিদেশী রাষ্ট্র আমাদের সাহায্য করবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে একটি নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্ব দেয়ার সুযোগ খুব কমই হয়েছে। স্বাধীকার প্রতিষ্ঠার অধিকার একটি আন্তর্জাতিক নীতি। যে কোন জনগোষ্ঠীর তাদের নির্বাচিত সরকার দ্বারা শাসিত হওয়ার অধিকার রয়েছে। পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাংলার মানুষের সে গণতান্ত্রিক অধিকারের অবমাননা করেছে। তাই আমাদের সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকার হরণই হচ্ছে জনগণের অধিকার হরণ।

 শেখ মনির বক্তব্য খণ্ডন করার জন্য দুটি যুক্তি দিলাম। শেখ মনির প্রস্তাবিত বিপ্লবী কাউন্সিল যদি বিভিন্ন মতাবলম্বীরা দুইটি, পাঁচটি বা সাতটি গঠন করে তাহলে জনগণ ও মুক্তিযোদ্ধারা কোনটির আদেশ মেনে চলবে না। কোন কাউন্সিলের সাথে বিদেশের সরকার সহযোগিতা করবে। এই ক্ষেত্রে একাধিক কাউন্সিল গঠনের সম্ভাবনাই নয় কি?

 সরকার প্রতিষ্ঠার অধিকারই হচ্ছে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা। আজকে সেই অধিকার প্রতিষ্ঠা না করে অন্য কোন বিপ্লবী কাউন্সিল গঠন করা হলে জনগণের মৌলিক অধিকারকে অবমাননা করা হবে। সেটা নিশ্চয়ই