পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/১৭১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

147 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড এলাকায় মূক ও শঙ্কিত নাগরিকদের অস্ত্রের হুঙ্কারে একটি তথাকথিত সাধারণ নির্বাচনের স্বাদ পেতে হয়তো চলছেন। বন্দী নাগরিকদের অন্ধকূপের মধ্যে নিক্ষেপ করে ইয়াহিয়া যে উপ-নির্বাচনের ফাঁদ পেতেছেন, গণহত্যার মতোই সেটা হবে তার আর একটি ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রমূলক রেকর্ড-প্রবঞ্চকের ডাইরীতে নতুন অধ্যায়ের সংযোজন। ভদ্রলোক রোগগ্রস্ত। মনস্তত্ত্ববিদগণ যেমন কোন কোন রোগীর মধ্যে বিশেষ জৈবিক প্রবণতা সন্ধান পান, মনোবিজ্ঞানের চেম্বারের উপস্থিত করলে ইয়াহিয়ার মধ্যেও রক্তপাতের প্রবল উন্মদনা পরীক্ষাযন্ত্রে ধরা পড়বে। জীবনে অন্ততঃ একটা বিজয় তার আছে- তা হচ্ছে অস্ত্রের ঝঙ্কারে বলপূর্বক পাকিস্তান দখল, রাষ্ট্রের সর্বময় ক্ষমতা কুক্ষিগত। অঙ্গুলি হেলনে তিনি নির্বাচন করেছেন, অঙ্গুলি আস্ফালনে তিনি গণহত্যার পৈশাচিক তাণ্ডবে সেনাদের লেলিয়ে দিয়েছেন। আবার খেয়াল-খুশী মতো নির্বচিত প্রতিনিধিদের আসনচ্যুত করার নির্দেশ দিয়ে আনন্দে আত্মহারা হয়েছেন। এই তোঘলকী হঠকারিতার উত্তরাধিকারী শৈলনিবাসী ভদ্রলোকে ইয়াহিয়া জানেন না যে, নির্বাচনে অনুষ্ঠানের নির্দেশ তিনি দিয়ে থাকতে পারেন; কিন্তু প্রতিনিধিদের সদস্যপদ খারিজের অধিকার তার নেই। কারণ, পরিষদ সদস্যগণ নির্বাচিত হয়েছেন জনগণের ভোটে, তার ভোটে নয়। এক্ষেত্রে ধনুক থেকে তীর তার নাগালের বাইরে চলে গেছে। তার এই উচ্ছঙ্খল চরিত্রটি একটি মাত্র অভিপ্রায় বা মনোবাসনা দ্বারা পরিচালিত, তা হচ্ছে অস্ত্রবলে বেআইনীভাবে ক্ষমতার মসনদ আইনানুগ ও চিরস্থায়ী করার অভিপ্রায়। পাগলাগারদের চিকিৎসকগণ এ রোগের একটা নাম দিয়েছেন। আপাতঃদৃষ্টিতে সুস্থ-সবল দেখতে, এমন কি মাত্রাধিক অমৃত রসধারা পান করেও লোকটি স্বাভাবিক মাতালের মতো ব্যবহার করে। কিন্তু বিশেষ বিশেষ আকাঙ্খা চরিতার্থে করার উদ্দেশ্যে সে অকস্মাৎ অস্বাভাবিক হয়ে পড়ে- তখন যেকোন ব্যক্তিকে সে হত্যা করতে পারে। বিশষজ্ঞগণ এ রোগকে “প্যারানাইয়া” বলেন। উন্মাদদের শ্রেণীবিন্যাস। নরহত্যার জেনারেল এই ইয়াহিয়া কলমের এক খোঁচায় আওয়ামী লীগের ৭৯ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের নির্বাচন বাতিল করেছেন। তিনি প্রাদেশিক পরিষদের ১৯৫ জন আওয়ামী লীগ সদস্যের পদ খারিজ করে আত্মতুষ্টি লাভ করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি নিজেই আবার আওয়ামী লীগ প্রধানরূপে অবশিষ্ট পরিষদ সদস্যদের উক্ত প্রতিষ্ঠান থেকে বহিষ্কার করে স্বপুরাজের ভবিষ্যৎ পরিষদে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে আসন গ্রহণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ “প্যারানাইয়া রোগে আক্রান্ত এই ভদ্রলোকের এক অস্বাভাবিক খেয়ালে দু’টি পরিষদে আওয়ামী লীগের মোট ৪৫৫ জন সদস্যপদ হারিয়েছেন এবং মোট যে ১৮১ জন সদস্যপদ হারাননি, তাদের ইয়াহিয়া খান নিজেই শেখ মুজিবের পক্ষে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করেছেন। এ যেন টােগোল্যাণ্ডের কোন এক ক্লান অধিনায়ক কর্তৃক ইংল্যাণ্ডের প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার নির্দেশের মতো। ইয়াহিয়ার এই স্বেচ্ছাচারমূলক অধিকারটা রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের কাছে উন্মাদের কার্যকলাপ বলেই পরিগণিত হচ্ছে, একথা আজ সত্যের মতো উজ্জ্বল। যে ২৭৪ জনকে অপরাধী বলে উল্লেখ করে সদস্যপদ খারিজ করেছেন, তাদেরই আবার বিচারের জন্যে কোর্টে উপস্থিত হতে বলেছেন। এ ক্ষেত্রে তিনি শাস্তি আগে দিয়েছেন, বিচার পরে হতে চলছে। শরীরের রক্তপ্রবাহ মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে; কিন্তু মানুষ যদি রক্ত পান করে, তবে তার কার্যক্রমে অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম ও অসঙ্গতি দেখা যায়- এ তারই দৃষ্টান্ত। এতো সামঞ্জস্যহীন কার্যপদ্ধতির মধ্যেও ইয়াহিয়া একটি বিশেষ উদ্দেশ্য সফল করতে চাচ্ছেন- এক ঢিলে দুই পাখী। অন্ততঃ কাল্পনিক পরিষদে আওয়ামী লীগকে এভাবে সদস্যপদ থেকে বঞ্চিত করা যাবে এবং গণহত্যার সহচরও ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী চক্রান্তকারী ভূট্টোকে সংখ্যালঘু দলের নেতার নেতারূপে পঙ্গু করা সম্ভব হবে।