পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২২৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

202 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড নয়। পাইকারী। কতলে আম! ধর্ম ছাড়া আরও হাজার রকম মানবিকতার মিল বাংলার হিন্দু-মুসলমানেরা মধ্যে বর্ণের দিক থেকে এক দেখতে একই রকম। পচিশে মার্চ থেকে নামটা উচ্চারণ করতে ঘৃণা হয়, টিক্কা খান ও অনুচরেরা বাঙালী ধ্বংস করতে নামল। এক মাস পরে যখন নিজেদের কৃতকর্মের চেহারা ওরা দেখতে পেল, তখন আবার সেই পুরাতন ফন্দি-সাম্প্রদায়িকতায় ফিরে গেল। প্রথম কিস্তি, হিন্দু মুসলমানকে নির্যাতন করছে, তাদের ঘরে আগুন দিয়েছে। কিন্তু শয়তানের জন্মগত খাসলৎ অভ্যাস কি সহজে যায়? জনসাধারণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির ফন্দি পুনরায় চালু হলো। এবার বেছে বেছে হিন্দু হত্যা, হিন্দুর গৃহদাহ ওরা শুরু করল। তাই বলে কেউ মনে করবেন না, মুসলমানদের তখন টিক্কা খান ভগ্নিপতির আদরে আপ্যায়িত করছিল। হিন্দুর ক্ষেত্রে প্রকাশ্যে, মুসলমানের ক্ষেত্রে অপ্রকাশ্যে। তফাৎ এতটুকু। বাঙালী ধ্বংসের পরিকল্পনা থেকে পাঞ্চাবী মুসলমান (হায় মুসলমানদের নামধারী!) সেনারা এতটুকু নড়েনি। কৌশল বদলেছিল, নীতি যথারীতি অব্যাহত । এইভাবে মুসলমানদের কাছে গোঁসাই ঠাকুর সাজার ফন্দি। নিজেদের অপরাধের বোঝা হাল্কা করার অপচেষ্টা ওরা নিয়েছিল। এইভাবে আমার মৃত সাম্প্রদায়িকতাকে খুঁচিয়ে তোলার চেষ্টা চলে। কিছুটা সফল হলো বৈকি পাঞ্জাবাগত এই হানাদারের দল নেজামে ইমাম ইসলাম, জামাতে ইসলামীর ধর্মান্ধ পশুর দল যারা এতদিন গণঅভু্যত্থানের সামনে কেচোর মত মাটিতে মিশেছিল, তারা তাদের মিলিটারী আব্বাজানের ডাকে এবং উৎসাহে কেউটের মত তৎপর হয়ে উঠল। নেজামে ইসলাম, জামাতে ইসলামীর গুণ্ডারা বাঙালী নয়। পাঞ্জাবী মিলিটারীরা সত্যি ওদের বাবা ও বাপজান। নচেত বাংলাদেশের মাটিতে জন্মে, বাংলার মা-বোনের বেইজ্জতি দেখেও ওরা কীভাবে মিলিটারীর সঙ্গে হাত মিলায়? যারা দেশকে বিদেশীর হাতে বিকিয়ে দিতে পারে, তারা মা-বোনকেও বিদেশীর হাতে বিকিয়ে দিতে সক্ষম। বাংলাদেশের যুদ্ধে বুদ্ধিজীবী, কবি, লেখক-আশা করি এই কথাটা স্মরণ রাখবেন। কিন্তু সকলেই তো নেজামে ইসলাম ও জামাতে ইসলামীর অনুচর নয়। সাড়ে সাত কোটির মানবজননী ংলাদেশের কি সাচ্চা সন্তান নেই, জন্মভূমির অপমান যাদের বুকে যন্ত্রণার ঝড় তোলে; দেশের চাষীমজুর ও অন্যান্য সকলের দুঃখ-কষ্ট যাদের বিচলিত করে। তারা এগিয়ে এসেছে বৈকি। শুধু এগিয়ে আসেনি অন্যায়ের নিজেদের ভবিষ্যতের কথা ভাবেননি। ইষ্ট পাকিস্তান রাইফেল, পুলিশ ভায়েদের গৃহসুখ , স্নেহমমতা ঘরে আটকে রাখতে পারেনি। জন্মভূমি প্রেমের বেদীতে সবকিছু বিসর্জন দিয়েছেন। আর আছে আমাদের দেশের তরুণেরা-যাদের অধিকাংশ স্কুল-কলেজের ছেলে। নিজেদের সকল সাধ-আরাম-আয়েস হারাম ভেবে যারা সৈনিকজীবনের কঠিন ব্রত গ্রহণ করেছে। হিন্দু-মুসলমান এখানে এক-কাতার। যে বিভেদ মারফৎ বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বাৰ্থ বছরের পর বছর শোষণ করেছে, তা মুছে দিয়ে এক-কাতারে দাঁড়িয়েছে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্ৰীষ্টান। নতুন বাংলাদেশ জন্ম নিয়েছে। নতুন আদর্শের প্রদীপ জুলিয়েছে আমাদের মুক্তিবাহিনী। সেই প্রদীপের শিখা-রোশনাই অনির্বাণ রাখার দায়িত্ব আমাদের, আমার যারা ঠিক লড়াইয়ের ময়দানে নেই, তারাও জন্মভূমির মুক্তিসংগ্রামে শরীক মনে রাখবেন, এই লড়াই সর্বাত্মক লড়াইয়ের পর্যায়ে পড়ে। আজ আমরা প্রত্যেকেরই সৈনক- হাতে হাতিয়ার থাক বা না থাক। পশ্চিম পাকিস্তানে তৈরি সামগ্রী যে কেনেনা সেও লড়াইয়ের ময়দানে আছে বৈকি। শত্রক সেও ঘায়েল করছে। আমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব আছে। যে পাটচাষী পাট চাষ করে না, ধান চাষ করে সেও লড়াইয়ে শরীক কোন সভ্য দেশে নজীর নেই, দুশমনেরা আমাদের প্রতিটি বাজারে চাল-ডাল ধ্বংস করে দিয়েছে, যেন আমাদের অন্ন না জোটে এবং দুর্ভিক্ষ আমাদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেয়- যার ফলে গোলামি আমরা শেষ পর্যন্ত মেনে নেব। এই চালেঞ্জ-তালু-ঠুকা-স্পর্ধার মোকাবিলা করছে সেই চাষী যে প্রচুর পরিমাণ ফসল ফলানোর চেষ্টায় কোমল বেঁধেছে এবং বৈদেশিক মুদ্রা যাতে শত্রু না পায় তার জন্যে সতর্ক-সে পাট করছে না। এই কৃষক কোন সৈনিকের চেয়ে কম নয় যদিও স্রেফ কাস্তেধারী, অস্ত্রধারী নয়। এমনিভাবে জন্মভূমির স্বাধীনতার লড়াইয়ে আমরা সকলেই শরীক হতে পারি।