পাতা:বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র (পঞ্চম খণ্ড).pdf/২৪১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

217 বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্রঃ পঞ্চম খন্ড সঙ্গে কথাবার্তার পর বুঝলাম এ স্থান ত্যাগ করতে আরও ঘন্টা তিনেক লাগবে। গভীর অন্ধকারের মধ্যে আমাদের এগোতে হবে এবং তাও ওদের সিগন্যাল পেলে তবেই। সুতরাং হাতে আমাদের অঢেল সময়। ওরা আমাদের জন্যে কিছু খাবর এনেছিলেন- ঢেকিভাঙ্গা চালের আটার রুটি আর হাঁসের মাংস। পাশের গ্রামের এক গৃহস্থ পরিবার আমাদের জন্যে এই খাবার পাঠিয়েছে। হাঁসের মাংসের হালকা একটা গন্ধ পেলাম।- বুকটা কেমন যেন ছ্যাৎ করে উঠলো- বুকের অনেক গভীরে একটা বেদনা, ভারী একটা যন্ত্রণা অনুভব করলাম। সন্ধ্যার অন্ধকার আর বিক্ষিপ্ত কুয়াশার সিড়ি ভেঙে আমার সমুখে যেন ধীরে ধীরে এগিয়ে আসছিলো আমার মা, আমার নিঃসন্তান বিধবা বড়ো আপার মুখ। বুকের ভিতরের যন্ত্রণাটা ক্রমশঃ যেন আমায় আচ্ছন্ন করে ফেলছিলো। হেমন্ত সন্ধ্যায় মাঠের তৃণের মতোই আমার দুচোখ আর্দ্র হয়ে উঠেছিলো। তাড়াতাড়ি করে কোন রকমে খাওয়া সেরে আমি আবার সেই ঝোপটার পাশে এসে বসলাম। একটা পোড়া সিগ্রেট ধরিয়ে সমুখে তাকিয়ে ছিলাম। সমুখের অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যায়- দেখা যায় আমার প্রিয় নগরী আমার ঢাকার প্রান্তদেশ পর্যন্ত। চারপাশে বহুদূর বিস্তৃত ঝোপঝাড় থাকলেও এখান থেকে সমুখের অনেক দূর দূর এলাকা দেখতে পাচ্ছিলাম। কারণ, আমি যে জায়গাটিতে বসে ছিলাম সেটি ছিলো বেশ উচুবলা যায়, এই বনান্তরে একটা উচু ঢেউয়ের চূড়ায় বসেছিলাম। সমুখের দিকে তাকিয়েছিলাম কিছুটা উদ্দেশ্যহীন এক দৃষ্টি নিয়ে। একটু পরেই জুলে উঠলো ঢাকার উপশহর সাভারের আলোকমালা। দেখতে পেলাম ঢাকা বেতারের হাইপাওয়ার ট্রান্সমিটারের টাওয়ার লাইট, লাল একটা জুলন্ত বুলেটের মতো ঝুলছে। সহকর্মীদের সঙ্গে দু’একটা কথার মাঝ দিয়ে আমার সময় কাটছিলো। কাজের কথাই বলছিলাম। মাঝে মাঝে বিচ্ছিন্ন প্রসঙ্গ যা ঘটনা নিয়েও আমরা কথা বলছিলাম। আর কয়েক ঘণ্টা পরেই আমরা রওয়ানা হবো। কিন্তু মাঝখানের সময়টা বড়ো অসহ্য মনে হচ্ছিল। আর এই অসহ্য ভাবটা কাটিয়ে ওঠার জন্যেই বেশ কিছুটা নির্ভাবনা ও নির্লিপ্ততার ভাব নিয়ে বিশ্রামের চেষ্টা করলাম। সমুখে ফেলে দেয়া জুলন্ত সিগ্রেটের থেকে শেষ ধোঁয়ার শীর্ণ রেখাটি তখন বিসর্পিল গতিতে একে বেঁকে ছোট্ট একটা শটিঝোপের দিকে মিলিয়ে যচ্ছিল। শটিবনে হারিয়ে যাওয়া ওই বিশীর্ণ নীল ধোঁয়ার মতোই মনটা আমার হারিয়ে গেল পিছনে ফেলে আসা নাম-না-জানা অনেক গ্রাম-জনপদ, নদী, নদীর তীরভূমি-মাঠ, মাঠের মাঝখানের বিজন বটগাছটি-আপনমনে ঘাস ছিড়ে খাওয়া কতগুলো গরু। আমি যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠের একান্তে বাঁধা একটা গরু-লম্বা মুখ তুলে উদাস চোখে তাকিয়ে আছে দূরের গ্রামটির দিকে। দেখতে পাচ্ছিলাম মাঠের মাঝখানে চিলতে একটুখানি জায়গায় জমে থাকা পানির ধারে ধারে গুচ্ছ গুচ্ছ কাশফুলের মতো অসংখ্য বক-কয়েকটা অল্প উচু দিয়ে ইতস্তঃত উড়েছে। গেল। উপশহর সাভারের ওই ঝিলমিল আলোকমালার চেয়ে অনেক স্পষ্ট হয়ে উঠলো আমার গ্রাম-গ্রামের মাঠের সেই বিজন বটতলাটি, যেখানে কেটেছে আমার শৈশবের দিনগুলোর অনেক অলস দুপুর, চারপাশের গ্রামের বৃত্তরেখার অনেক ওপরে ছড়ানো আমার সেই শিশু আমির কল্পনাগুলো যেখানে রামধনু হয়ে থাকতো।